ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে যা করতে হবে

মিষ্টি খাওয়া কমাতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

আজ ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’। দিবসটির ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য—‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন’। এ প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য বুঝতে হলে কিছু বিষয় আগে জানতে হবে।

ডায়াবেটিস কী, কেন হয়

এখনো অনেকই মনে করেন মিষ্টি খেলে বা খাবার বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়, ধারণাটি ভুল। মূলত সরাসরি কোনো খাবার খাওয়া বা না–খাওয়ার জন্য ডায়াবেটিস হয় না। শুধু শরীরে ইনসুলিন হরমোনের ঘাটতিতেই একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়ে থাকে, আর তখন রক্তে চিনি বা সুগার বাড়ে।

কাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি

১. যেসব নতুন মায়ের শরীরের ওজন বেশি।

২. যাঁদের পেটে চর্বি বেশি।

৩. যাঁরা শারীরিক পরিশ্রম কম করেন বা অধিকাংশ সময় বসে থাকেন।

৪. পারিবারিকভাবে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের সন্তানদের ইনসুলিনের অভাব হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

৫. প্রিডায়াবেটিস (যাঁদের আইজিটি/আইএফজি আছে) থাকলে।

৬. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে।

৭. গর্ভাবস্থায় পুষ্টির অভাব হলে।

৮. অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে থাকলে।

পরিসংখ্যান

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, পাশাপাশি প্রতি ২ জনের ১ জনের এখনো নির্ণয় করা হয়নি। অন্যদিকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিক মায়েদের সন্তানদের প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে, যাদের পরবর্তীকালে টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক রোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশ ই টাইপ-২ ধরনের, যাঁদের প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জন আমাদের মতো দেশগুলোতে বাস করেন। ফলে এখনো যদি আমরা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন না হতে পারি, তাহলে ২০৩০ সালে আরও প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে, পাশাপাশি ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে হতে পারে অন্ধত্ব, কিডনি বৈকল্য, হৃদ্‌রোগ ও অন্যান্য গুরুতর জটিলতা। ডায়াবেটিস ঝুঁকি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয় সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো কী হতে পারে, তা জানতে ও মানতে হবে।

প্রতিদিন ব্যায়াম করুন
ছবি: প্রথম আলো

করণীয়

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে একজন ব্যক্তিকে, বিশেষ করে যাঁরা বেশি ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করতে হবে।

স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও জীবনযাপন

১. খাবারে শর্করা কমান: আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ভাত ও অন্যান্য শর্করা খেয়ে পেট ভরান। পাশাপাশি খাবারে চিনি বেশি ব্যবহার করেন। এতে রক্তে শর্করা ও ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা থেকে শেষ পর্যন্ত ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

২. পরিমিত খান

যেকোনো ব্যক্তির প্রতিদিন কতটা শক্তি প্রয়োজন, তার চাহিদা নিরূপণ করে, সেই অনুযায়ী খাবার খেতে পারলে শরীর সুস্থ রাখা সম্ভব। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খেলে ধীরে ধীরে ওজন বাড়তে থাকে। অন্যদিকে চাহিদার থেকে কম খেলে দুর্বলতাসহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেবে।

৩. সময়মতো খান

প্রতিদিন, প্রতিবেলার খাবার একই সময়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে অ্যাসিডিটি, পেট ফাঁপাসহ নানা সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

৪. অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন

পোড়া তেলে রান্না, বাসি খাবার, খাবারের স্বাদ বাড়াতে অতিরিক্ত চর্বি, চিনি, লবণ, মসলা, মেয়নেজ ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন। এসব খাবার থেকে উচ্চ রক্তচাপ, রক্ত, লিভার, হার্টে চর্বি জমার ঝুঁকি বাড়ে। অন্যদিকে ওজন বাড়তে থাকে। যার থেকে ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিস–পরবর্তী জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে।

৫. কার্বোনেটেড ড্রিংক বা জুস বাদ দিন

কার্বোনেটেড ড্রিংক বা জুসে প্রচুর চিনি (১ গ্লাস ড্রিংকসে প্রায় ৮ চা-চামচ চিনি থাকে), সোডা ইত্যাদি থাকে। এই সোডা ও মিষ্টি ফলের রসের মতো চিনিযুক্ত পানীয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস (প্রায় ২০ শতাংশ) এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সুপ্ত অটো ইমিউন ডায়াবেটিসের (প্রায় ৯৯ শতাংশ) ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত। তাই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে আপনার প্রধান পানীয় হিসেবে সাধারণ পানি পান করুন।

৬. আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খান

গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইবারযুক্ত খাবার, বিশেষ করে দ্রবণীয় ফাইবার ও জল আপনার পরিপাকতন্ত্রে একটি জেল তৈরি করে, যা খাদ্যশোষণকে ধীর করে দেয়। রক্তে শর্করার পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তে শর্করা ও ইনসুলিনের মাত্রা কম রাখতে, ওজন কমাতে ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৩৫ গ্রাম ফাইবার রাখা প্রয়োজন খাবারে।

৭. ওজন স্বাভাবিক রাখুন

শরীরের অতিরিক্ত ওজন, বিশেষ করে ভিসারাল ফ্যাট (আপনার শরীরের মাঝামাঝি অংশে এবং আপনার পেটের অতিরিক্ত ওজন) ইনসুলিন প্রতিরোধ, প্রদাহ, প্রিডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ওজনের মাত্র ৫-৭ শতাংশ কমাতে পারলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে চায়ে চিনি এড়িয়ে চলুন
ছবি: প্রথম আলো

৮. ব্যায়াম/শারীরিক পরিশ্রম বাড়ান

প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাঁরা প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বসে থাকেন—১০ বা তার বেশি ঘণ্টা—তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণের বেশি।

৯. গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করুন

গর্ভকালে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে হতে পারে নানা জটিলতা। গর্ভস্থ শিশু ম্যাক্রোসোমিক (৪ কেজির বেশি ওজন) হলে পরে ওজনাধিক্য ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং মায়ের জিডিএম থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। অন্যদিকে পুষ্টিঘাটতি নিয়ে গর্ভস্থ শিশু কম ওজনসহ (< ২.৫ কেজি) বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। পরে যাদের পুষ্টিহীনতা ও ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও গর্ভবতীর যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করে পরবর্তী প্রজন্মের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

খাবারকে শুধু পেট ভরানোর একমাত্র উপাদান না ভেবে সঠিক, সুষম ও স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিচাহিদা পূরণের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। অন্যান্য রোগসহ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রেখে জটিলতার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

লেখক: শামছুন্নাহার নাহিদ, প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, ডায়েট ও নিউট্রিশন বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল