এই সময়ে টাইফয়েড

পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড। অন্ত্রনালিতে জীবাণু সংক্রমণের ফলে এটি হয়। স্যালমোনেলা টাইফি ও প্যারাটাইফি নামের ব্যাকটেরিয়া এর জন্য দায়ী। অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং দূষিত পানি পানের মাধ্যমে এই জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। দেখা দেয় জ্বর, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া ও অন্যান্য উপসর্গ। টাইফয়েডের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলেই কেউ আক্রান্ত হবেন—এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো থাকলে অনেক সময় জীবাণু দেহে সংক্রমণ করতে পারে না। উন্নত বিশ্বে এই রোগের প্রাদুর্ভাব নেই বললেই চলে।

যেকোনো বয়সের মানুষেরই টাইফয়েড হতে পারে। তবে শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। টাইফয়েডের জীবাণু আক্রান্তের মল ও অপরিষ্কার হাতের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও টাইফয়েড ছড়াতে পারে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানি পান, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন যাপন করলে সহজেই টাইফয়েডের সংক্রমণ ও জটিলতা এড়ানো যায়।

টাইফয়েডের উপসর্গ
•তীব্র জ্বর ও কাশি
•বমি ভাব বা বমি
•অতিরিক্ত ক্লান্তি
•মাথাব্যথা
•ডায়রিয়া
•ক্ষুধামান্দ্য
•গলাব্যথা
•কোষ্ঠকাঠিন্য
•পেটে ও পিঠে দানা
•প্রলাপ

টাইফয়েডের জটিলতা
টাইফয়েডের প্রথম সপ্তাহে জ্বর, শরীরব্যথা, বমি বা পাতলা পায়খানার মতো সমস্যা থাকে। প্রথম পাঁচ দিন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও সপ্তাহ শেষে পেট ফুলে যাওয়া, প্রচণ্ড কাশি, প্লীহা বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
টাইফয়েড জটিল আকার ধারণ করলে পরবর্তী সময়ে অন্ত্রনালি ফুটো হয়ে যাওয়া, অন্ত্রে রক্তক্ষরণ হতে পারে। দেখা দিতে পারে পিত্তথলি, হৃৎপিণ্ড ও হাড়ের জটিলতা। তাই দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এড়াতে শুরুতেই টাইফয়েডের চিকিৎসা করাতে হবে।

চিকিৎসা
গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে আমাদের দেশে টাইফয়েডের প্রকোপ বাড়ে। উপসর্গ প্রকাশের পরপরই দ্রুত টাইফয়েডের চিকিৎসা নিতে হবে। টাইফয়েড হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হতে প্রথমেই রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। রক্তের কালচার হচ্ছে টাইফয়েড নির্ণয়ের সর্বোত্তম পরীক্ষা।

পরীক্ষা করে টাইফয়েডের জীবাণু পাওয়া গেলে ১০ থেকে ১৪ দিনের অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার পর রোগীর সেরে উঠতে পাঁচ দিন সময় লাগতে পারে। এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে, চিকিৎসক যত দিন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেবেন, তত দিন পর্যন্ত অবশ্যই ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে বা ওষুধ খাওয়ার পরেও জ্বর না কমলে টাইফয়েড জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

টাইফয়েডে জ্বর ও ডায়রিয়ার কারণে শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। এ সময় শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টি জোগাতে রোগীকে প্রচুর তরল ও ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। জ্বর বেশি থাকলে শরীর বারবার মুছে দিতে হবে। প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

টাইফয়েড প্রতিরোধ
টাইফয়েড প্রতিরোধে চিকিৎসকের পরামর্শমতো নির্দিষ্ট টিকা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ ছাড়া টাইফয়েডের পর দ্রুত সুস্থ হতে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস জরুরি।
•নিয়মিত শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
•এ সময় প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরি। পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারে।
•বাইরের লাচ্ছি, ফালুদা, শরবত বা জুসের মতো পানীয়তে মেশানো বরফ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিশুদ্ধ পানিতে বরফ তৈরি না হলে সেটি এড়িয়ে যেতে হবে।
•কাঁচা খাবার এড়িয়ে ভালোভাবে সেদ্ধ করে রান্না করা খাবার খেতে হবে।
•খাবার খাওয়া ও পরিবেশনের আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
•বাইরের খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
•শিশুর মলমূত্র ও পোশাক ভালোভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে।
•শিশুরা বারবার মুখে হাত দেয় তাই শিশুর হাত ও খেলনা জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
•টয়লেট সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
•প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।

লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা