ল্যাপারোস্কপিক অস্ত্রোপচার কি যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়ায়

যক্ষ্মা প্রতিরোধে হাঁচি–কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে
ছবি: কবির হোসেন

এখনো বিশ্বজুড়ে অন্যতম এক স্বাস্থ্য সমস্যা যক্ষ্মা। যেসব দেশে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি বা যেসব দেশ যক্ষ্মার বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতি মিনিটে একজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এখনো যক্ষ্মায় মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১২ মিনিটে একজন যক্ষ্মা রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

যক্ষ্মা নির্ণয় ও যক্ষ্মা চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, রোগীবান্ধব চিকিৎসাব্যবস্থা ও সমন্বিত কার্যক্রম। নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীরই যে কেবল যক্ষ্মার ঝুঁকি রয়েছে, তা কিন্তু নয়। যেকোনো ব্যক্তির যেকোনো বয়সেই যক্ষ্মা হতে পারে।

যক্ষ্মা কি কেবল ফুসফুসের রোগ

শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর যক্ষ্মা ফুসফুসে হয়ে থাকে। কিন্তু শরীরের যেকোনো অঙ্গেই হতে পারে যক্ষ্মা। পরিপাকতন্ত্র, টনসিল, মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড কিংবা অন্য স্থানের হাড়, অস্থিসন্ধি (জয়েন্ট), কিডনি, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি এবং দেহের যেকোনো জায়গার লসিকা গ্রন্থিতে যক্ষ্মার সংক্রমণ হতে পারে। ত্বকের বিভিন্ন অংশেও যক্ষ্মা হয়। দেহে কোনো ক্ষত থাকলে সেই জায়গাতেও হতে পারে যক্ষ্মার সংক্রমণ, অস্ত্রোপচারের জায়গা বা পুরোনো কোনো ক্ষতেও হতে পারে এই সংক্রমণ।

যক্ষ্মা কীভাবে ছড়ায়

যক্ষ্মা বায়ুবাহিত রোগ। শ্বাসপ্রশ্বাসের সময়, হাঁচি–কাশি দেওয়ার সময়, কথা বলার সময়, এমনকি হাসির সময়ও রোগীর কাছ থেকে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। তা ছাড়া দুধের মাধ্যমেও যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। জীবাণুমুক্ত করা হয়নি, এমন দুধ পান করলে কিংবা তা দিয়ে তৈরি অন্য কোনো খাবার গ্রহণ করলে যক্ষ্মার জীবাণু আপনার শরীরে প্রবেশ করার ঝুঁকি থাকে।

ঝুঁকিতে আছেন যাঁরা

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যক্ষ্মা ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি। বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, এ রকম বদ্ধ পরিবেশে বসবাসকারীর যক্ষ্মার ঝুঁকি থাকে। তবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করলেই যে যক্ষ্মা হবে না, এমন নয়। যাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম কিংবা যাঁদের ফুসফুস কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁরা যেকোনো পরিবেশেই যক্ষ্মার ঝুঁকিতে থাকেন।

  • ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি বা ফুসফুসের রোগ কিংবা এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে।

  • সিগারেটসহ অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনকারী ব্যক্তিও রয়েছেন যক্ষ্মার ঝুঁকিতে।

  • বয়সও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু, ৬৫ বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তির যক্ষ্মা হতে পারে।

  • যাঁদের ওজন কম কিংবা কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হয়েছে, তাঁদেরও যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

  • ক্যানসার রোগীর কেমোথেরাপি চলার সময় কিংবা কেউ যখন স্টেরয়েড বা এ–জাতীয় কোনো ওষুধ গ্রহণ করেন, যাতে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, তাঁরাও থাকেন যক্ষ্মার ঝুঁকিতে।

  • চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিরা যক্ষ্মার ঝুঁকিতে থাকেন।

যক্ষ্মার আছে নানা ধরন

যক্ষ্মার জীবাণু মূলত দুই ধরনের। একটি হলো সাধারণ বা গতানুগতিক যক্ষ্মার জীবাণু। নামে ‘সাধারণ’ হলেও সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি থেকেও জীবননাশের শঙ্কা থাকে। অন্যটি হলো অ্যাটিপিকাল টিউবারকুলোসিস অর্থাৎ অগতানুগতিক যক্ষ্মা। এই শ্রেণিতে বেশ কিছু জীবাণু রয়েছে। যক্ষ্মার সব কটি ধরনই খারাপ ধরনের সংক্রমণ করে। 

অ্যাটিপিকাল যক্ষ্মার জীবাণু সাধারণত পরিবেশে মিশে থাকে, বিশেষ করে পানি, মাটি ও খাবারে। গতানুগতিক যক্ষ্মার চেয়ে এই রোগের বিস্তার এবং উপসর্গে ভিন্নতা আছে। এটিও ফুসফুস, লসিকা গ্রন্থি কিংবা ত্বকে সংক্রমণ করতে পারে। তা ছাড়া শরীরে স্থাপিত বিভিন্ন ডিভাইসেও (যেমন পেসমেকার কিংবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের রোগীর দেহের মূল শিরায় দেওয়া সেন্ট্রাল লাইন) সংক্রমণ করে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে রক্তেও। শরীরের পুরোনো ক্ষত, অস্ত্রোপচারজনিত ক্ষত, দুর্বল রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা, বিশেষ করে ফুসফুসের অসুখজনিত দুর্বলতা এ ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

যেকোনো বয়সেই মানুষের যক্ষ্মা হতে পারে
ছবি: কবির হোসেন

প্রয়োজন দ্রুত শনাক্তকরণ

যক্ষ্মা যে ধরনের জীবাণু দিয়েই হয়ে থাকুক না কেন, দ্রুত শনাক্ত করাটা অত্যন্ত জরুরি। কেননা, রোগনির্ণয়ে যত দেরি হবে, ততই বাড়তে থাকবে জটিলতা। শরীরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে। একপর্যায়ে জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। একই সঙ্গে রোগী থেকে অন্যদের মধ্যেও যক্ষ্মা সংক্রমিত হতে থাকবে। অথচ সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যায়। তাই চিকিৎসকের মূল চ্যালেঞ্জটাই হচ্ছে যক্ষ্মা শনাক্ত করা। তাই যক্ষ্মার উপসর্গ সম্পর্কে জানতে হবে সবারই। আরেকটি কথা, জ্বর বা যেকোনো সংক্রমণজনিত উপসর্গ হলেই অনেকে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন। এতে যক্ষ্মা শনাক্ত করা জটিল হয়ে পড়ে।

যক্ষ্মার মূল উপসর্গ

যক্ষ্মা কোথায় হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যক্ষ্মা ফুসফুসে হয় বলে রোগীর কাশি থাকে। যক্ষ্মার মূল উপসর্গ হলো মৃদু জ্বর কিংবা জ্বর জ্বর অনুভূতি, কাশি, খাওয়ার রুচি ও ওজন কমে যাওয়া, রাতে প্রচুর ঘাম হওয়া ইত্যাদি। কাশির সঙ্গে রক্তও যেতে পারে। শ্বাসপ্রশ্বাসে অসুবিধা হতে পারে। কারও যদি দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাশি হয়, মৃদু জ্বর থাকে, খাবারে অরুচি কিংবা ওজন কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ থাকে, দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

অন্যান্য উপসর্গ

  • ফুসফুসের পর্দায় হলে সেখানে পানি জমে যায়, ফলে শ্বাসকষ্ট ও বুকের নির্দিষ্ট স্থানে ব্যথা হয়ে থাকে।

  • পেটে যক্ষ্মা হলে পেটব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, কয়েক দিন পরপরই পাতলা পায়খানা কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া—এসবই হতে পারে উপসর্গ।

  • লসিকা গ্রন্থি আক্রান্ত হলে ফুলে যায়। ওই অংশে অস্বাভাবিক ফোলা বা গোটাজাতীয় কিছুর উপস্থিতি অনুভব করেন রোগী।

  • ত্বকে যক্ষ্মা হলে বিশেষ ধরনের ক্ষত দেখা দেয়, সহজে যা নিরাময় হয় না।

  • ক্ষত থেকে রস নিঃসৃত হতেও দেখা যায়। আক্রান্ত স্থানে পুঁজ জমে বড়সড় ফোড়াজাতীয় ক্ষতও হতে পারে।

  • হাড়ে যক্ষ্মা হলে আক্রান্ত স্থানে ব্যথা, ফোলা ভাব কিংবা ওই অংশের পেশির দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। শরীরের অন্যান্য অংশের হাড়ের চেয়ে মেরুদণ্ডের হাড়ে যক্ষ্মা হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে রোগীর পিঠে ব্যথা বা পিঠের কোনো অংশে পুঁজ জমার মতো উপসর্গ থাকে। পিঠের স্বাভাবিক আকৃতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী কুঁজো হয়ে যান। তা ছাড়া মেরুদণ্ডের ভেতর দেহের মূল স্নায়ুগুলো থাকে বলে অনেকের দুই পা কিংবা চার হাত-পায়ের পেশিও দুর্বল হয়ে পড়তে দেখা যায়।

  • সন্ধিতে যক্ষ্মা হলে আক্রান্ত সন্ধি ফুলে যায়, স্বাভাবিক আকৃতি হারায়, ব্যথা হয়, আশপাশের পেশি শুকিয়ে যায়।

  • মস্তিষ্কে যক্ষ্মা হলে রোগীর প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, রোগী ঘাড় নাড়াতে পারেন না, অনেক সময় রোগীর খিঁচুনি হয়, রোগী এলোমেলো কথা বলেন, এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে পড়তে পারেন।

  • অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি আক্রান্ত হলে রোগীর রক্তচাপ কমে যায়। রোগী দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। বমিও হয়। ত্বকের কোথাও কোথাও কালচে দাগ দেখা যায়।

এ ধরনের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সাধারণত প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট উপসর্গের পাশাপাশি মৃদু জ্বর, ওজন কমে যাওয়া এবং শারীরিক দুর্বলতা থাকতে পারে।

ল্যাপারোস্কপিক অস্ত্রোপচার কি যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়ায়: ল্যাপারোস্কপিক অস্ত্রোপচারের সুবিধা অনেক। দিন দিন এই সুবিধা গ্রহণ করা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে ল্যাপারোস্কপিক অস্ত্রোপচারের পর ক্ষতস্থান না শুকানোর একটি কারণ ক্ষতস্থানে যক্ষ্মা সংক্রমণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই ধরনের সংক্রমণ বেশি বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। ল্যাপারোস্কপিক অস্ত্রোপচারের জন্য যে বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সঠিকভাবে তা জীবাণুমুক্ত করে নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগীদের সুস্থতায় এই দায়িত্ব হাসপাতালের। আসলে ল্যাপারোস্কপিক অস্ত্রোপচারে যক্ষ্মার বাড়তি কোনো ঝুঁকি নেই। পুরোটাই আসলে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি জীবাণুমুক্ত করার বিষয়।

রোগের পরীক্ষায় না–ও পাওয়া যেতে পারে জীবাণু

কফ পরীক্ষা ও বুকের এক্স–রে যক্ষ্মা শনাক্তকরণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের কিছু পরীক্ষাও করাতে হয়। এ ছাড়া আক্রান্ত স্থান থেকে রস নিঃসৃত হলে তা নিয়েও পরীক্ষা করা হয়। সেখানে কোনো পুঁজ বা তরল জমা হলে তা–ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। মস্তিষ্কের সংক্রমণ সন্দেহ করলে মেরুদণ্ড থেকে একধরনের রস সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। সব যক্ষ্মা রোগীর ক্ষেত্রেই যে রোগের জীবাণুর সরাসরি উপস্থিতি দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। আবার জীবাণুর উপস্থিতি নির্ণয় করা না গেলেই যে রোগীর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু নেই, এ কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। কিন্তু একজন চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ শুনে এবং প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা করে রোগ সম্পর্কে নির্ভুল অনুমান করার মতো দক্ষতা অর্জন করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে যক্ষ্মার উপস্থিতির পক্ষে বা বিপক্ষে যেতে পারে। রোগীর জীবন বাঁচাতে ও রোগীর কষ্ট লাঘব করতে একজন চিকিৎসক তাঁর জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থেকে রোগনির্ণয় করতে সক্ষম। তাই রোগনির্ণয়ের নানা ধাপ পেরিয়ে আপনার চিকিৎসকের মতে যদি যক্ষ্মাই হয় আপনার রোগ, তাহলে সেটিকে অবশ্যই যক্ষ্মা হিসেবে চিকিৎসা করাতে হবে। জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে কি যায়নি, এ নিয়ে দ্বিধা করা যাবে না।

মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না

চিকিৎসকের পরামর্শমাফিক যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করা হয়। সবাই জানেন, যক্ষ্মার চিকিৎসা চলে দীর্ঘদিন। ন্যূনতম ছয় মাস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক থেকে দুই বছর ধরেও যক্ষ্মার চিকিৎসা চালানো লাগতে পারে। নির্দেশনামাফিক ওষুধ সেবন করুন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে সেবন করতে হয় যক্ষ্মার ওষুধ। ওষুধ সেবনের ৪৫ মিনিট পার হওয়ার আগে খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে সেবন করতে হয় বলে ওষুধ খেতে ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকে, সেগুলোর প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়। নিয়মমাফিক ওষুধ সেবন করা না হলে বা মাঝে বাদ পড়লে যক্ষ্মার জীবাণুগুলো ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। তখন আর গতানুগতিক ওষুধ কাজ করে না। তাতে বাড়ে রোগীর দুর্ভোগ। তখন রোগীর সুস্থতায় নতুন ধরনের ওষুধ যুক্ত করতে হয়। আরও দীর্ঘায়িত হয় চিকিৎসা। তাই রোগী এবং তাঁর আপনজন প্রত্যেকেরই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ওষুধ খেতে ভুল না হয়। প্রয়োজনে রোজ নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ সেবনের জন্য অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন। 

রোগের উন্নতি হচ্ছে বা আগের চেয়ে ভালো লাগছে, জ্বর নেই বলে চিকিৎসা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তেমনি উন্নতি হতে সময় লাগছে, এই ওষুধে আর কাজ হবে না—এমনটাও ভুল ধারণা। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই যক্ষ্মার ওষুধ বন্ধ করবেন না।

চাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন

যক্ষ্মা ছোঁয়াচে রোগ। কিন্তু সে কারণে যে যক্ষ্মা রোগীকে আলাদা ঘরে রাখতে হবে কিংবা তাঁর পরিবারকে একঘরে করে ফেলতে হবে, তা কিন্তু নয়। যক্ষ্মা রোগীকে স্পর্শ করলে, তাঁর সঙ্গে হাত মেলালে, তাঁকে জড়িয়ে ধরলে যক্ষ্মা হয় না। তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী অন্য কেউ ব্যবহার করলেও ক্ষতি নেই, এমনকি এক থালাতে খাবার খেলে বা একই পাত্রে পানি খেলেও যক্ষ্মা হবে না। রোগীর ব্যবহৃত ওয়াশরুমে কেউ গেলেও সে যক্ষ্মা আক্রান্ত হবে না। রোগীর ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে দিলে, এমনকি তাঁর প্রস্রাব, পায়খানা কিংবা বমি পরিষ্কার করলেও যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি নেই। তবে রোগীর যদি কাশি থাকে, তাহলে রোগীর কাছে যতক্ষণ কেউ থাকবেন, ততক্ষণই তাঁকে এবং রোগীকে মাস্ক পরে থাকতে হবে। তবে রোগীর কাশি ভালো হয়ে গেলে সেটিরও আর প্রয়োজন পড়ে না। আর কফ-থুতু সব সময়ই ফেলতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে। হাসপাতালে ভর্তির মতো জটিল অবস্থার সৃষ্টি না হলে বাড়িতেই চিকিৎসা সম্পন্ন করা সম্ভব। তবে উপসর্গের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত পরিবার বা আপনজন ছাড়া অন্য কারও সংস্পর্শে না আসাই ভালো। তাই এই সময়টুকু গণপরিবহন এড়িয়ে চলুন, যেসব স্থানে অনেক মানুষের সমাগম হয় (যেমন স্কুল, বাজার বা কর্মক্ষেত্রে), সেখানে যাবেন না। প্রতিবেশী, আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে এই কয়েকটা দিন আসা-যাওয়া না রাখাই ভালো। রোগীর জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করাও বাঞ্ছনীয়।

চিকিৎসাসংক্রান্ত আরও কিছু বিষয়

কারও কারও ক্ষেত্রে ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ওষুধ শুরু করার পর যেকোনো নতুন সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসককে জানাতে হবে। তিনি ওষুধের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে দেবেন। তবে নিজে থেকে ওষুধ বাদ দিয়ে দেবেন না। কোনো একটি ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে সেটির পরিবর্তে অন্য ওষুধ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যক্ষ্মার কিছু ওষুধ অন্যান্য কিছু রোগের ওষুধের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। তাই যক্ষ্মার ওষুধ চলমান অবস্থায় কিছু ওষুধ রোগীর শরীরে কাজ করে না, আবার অন্য কিছু ওষুধের মাত্রা কমিয়েও দিতে হতে পারে। তাই আপনি যদি অন্য কোনো ওষুধ সেবন করেন, তাহলে সেটিও চিকিৎসককে জানান। তিনি বলে দেবেন যে এসব ওষুধের সঙ্গে যক্ষ্মার ওষুধের মিথস্ক্রিয়া হয় কি না। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের বিষয়েও তিনি আপনাকে নির্দেশনা দিয়ে দেবেন।

রোগীর স্বজনদেরও চিকিৎসা লাগতে পারে

একের থেকে অন্যের মধ্যে নীরবেই ছড়িয়ে পড়তে পারে যক্ষ্মা। তাই কোনো রোগীর যক্ষ্মা নির্ণয় হওয়ার পর কাছের মানুষদের একটু সচেতন হতে হবে। যক্ষ্মার উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময় থেকে যাঁরা রোগীর সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করেছেন কিংবা একই সঙ্গে চলাফেরা করেছেন, এমন মানুষদের মধ্যে কারও যদি যক্ষ্মার কোনো লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবেন, প্রয়োজনে তাঁকেও যক্ষ্মার কিছু ওষুধ দেবেন।

সুপ্ত যক্ষ্মা কী

অনেক ক্ষেত্রেই মানবদেহে যক্ষ্মা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ কোনো উপসর্গ ছাড়াই শরীরে লুকিয়ে থাকে যক্ষ্মার জীবাণু। যতক্ষণ ওই ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা স্বাভাবিক আছে, ততক্ষণ এই জীবাণু তাঁর শরীরে কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না। কিন্তু তিনি আসলে যক্ষ্মার বাহক। তাঁর হাঁচি–কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই জীবাণু প্রবেশ করতে পারে এমন ব্যক্তির শরীরে, যাঁর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। তাঁদের দেহে জীবাণু প্রবেশ করলে তাঁরা কিন্তু সহজেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। আবার যাঁর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, তাঁর নিজেরও যদি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কোনো কারণে কমে যায়, তখন এই ঘুমিয়ে থাকা জীবাণু জেগে ওঠে। এই সময় তাঁর নিজেরও যক্ষ্মা হতে পারে। যাঁদের শরীরে যক্ষ্মা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকেরই যে যক্ষ্মার চিকিৎসা প্রয়োজন, তা কিন্তু নয়। যাঁদের বয়স, রোগ কিংবা কোনো ওষুধের কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, কেবল তাঁদেরই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসার ধরন যক্ষ্মার চিকিৎসার চেয়ে একটু ভিন্ন। মেয়াদ তিন মাস।

যক্ষ্মা প্রতিরোধে চাই জনসচেতনতা

যেহেতু যক্ষ্মা অনেকের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়, সেহেতু যক্ষ্মার উপসর্গ থাকুক কিংবা না থাকুক, প্রত্যেক মানুষকেই হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। যেখানে সেখানে কফ-থুতু ফেলা যাবে না। উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। যক্ষ্মার টিকা রয়েছে। বিসিজি টিকা হলো যক্ষ্মার টিকা, যা জন্মের পরপরই দিয়ে দেওয়া হয় প্রত্যেক শিশুকে। এই টিকা যক্ষ্মা প্রতিরোধ করবে, তা কিন্তু নয়। জন্মের পর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। এই সময় যক্ষ্মা হলে সহজেই জটিল আকার ধারণ করার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু বিসিজি টিকা দেওয়া থাকলে শিশুর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু প্রবেশ করলেও তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে না। তাই বিসিজি টিকা যক্ষ্মা থেকে রক্ষা করতে না পারলেও শৈশবে মারাত্মক যক্ষ্মা থেকে বাঁচার জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয়।

জটিলতার চিকিৎসা

যক্ষ্মার জীবাণু দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ার ফলে নানা জটিলতা হতে পারে। মস্তিষ্ক বা মেরুদণ্ডে যক্ষ্মা হলে যেমন রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, তেমনি একজন নারীর যদি ডিম্বাশয় বা ডিম্বনালিতে যক্ষ্মা হয়, তাহলে তিনি সন্তানধারণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলতে পারেন। চিকিৎসার অভাবে যক্ষ্মা রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। (অনুলিখিত)

*প্রথম আলোর স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ আয়োজন ‘বর্ণিল ভালো থাকুন ২০২৩’ থেকে লেখাটি নেওয়া।