এসব স্নায়ুরোগের লক্ষণ আপনার মধ্যেও নেই তো?
এই স্নায়ুরোগগুলোর কোনোটি আপনার চেনা, কোনোটি অচেনা। তবে রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষ আপনার আশপাশেই আছে।
গুলেন বারি সিনড্রোম
গুলেন বারি সিনড্রোমে (জিবিএস) রোগীর হাত-পা হঠাৎ দুর্বল হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার দু–এক সপ্তাহ আগে রোগীর পাতলা পায়খানা অথবা সর্দি, কাশি, জ্বর হয়ে থাকে। অনেক সময় টিকা দেওয়ার পরও এই রোগ হতে পারে।
এই রোগে রোগীর হঠাৎ পা অবশ হয়ে যায়, অবশ ভাব ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠতে থাকে, একসময় হাতও আক্রান্ত হয়। অনেক সময় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়; যা রোগীকে খুবই সংকটাপন্ন অবস্থায় নিয়ে যায়।
জিবিএসে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই রোগীকে প্লাসমাফেরেসিস অথবা ইমিউনো গ্লোবিউলিন নামক ইনজেকশন প্রদান করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দেরি না করে রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করানো উচিত। জিবিএস রোগীর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অপরিসীম। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা গেলে প্রায় ৮০ শতাংশ জিবিএস রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।
ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া
আমাদের মুখের অনুভূতি মস্তিষ্কে নিয়ে যায় ট্রাইজেমিনাল। কোনো কারণে এই স্নায়ু আক্রান্ত হলে রোগীর মুখে তীব্র ব্যথা হয়; যাকে বলে ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর মুখের যেকোনো একটি পার্শ্বে ইলেকট্রিক শকের মতো তীব্র ব্যথা হয়।
দাঁত মাজতে গেলে বা কিছু কামড়াতে গেলে এই রোগ বেড়ে যায়। সাধারণত মস্তিষ্কের রক্তনালি দ্বারা ট্রাইজেমিনাল নার্ভে চাপ পড়ার কারণেই এই রোগ হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্রেন টিউমার অথবা মাল্টিপল স্কেলরোসিস নামের রোগেও এই সমস্যা হতে পারে।
ট্রাইজেমিনাল নিউরোলজিয়ার চিকিৎসা মূলত দুই প্রকার: ওষুধ ও শল্য চিকিৎসা। কার্বামাজেপিন জাতীয় ওষুধ এই রোগে খুবই কার্যকর। কার্বামাজেপিনের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে; তাই এই ওষুধ সেবনের সময় রোগীদের সতর্ক থাকা উচিত। মাইক্রোভাসকুলার ডিকম্প্রেশন নামের শল্য চিকিৎসা এই রোগে খুবই কার্যকর।
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি
হাত–পা ঝিনঝিন করার অনুভূতি খুবই অস্বস্তিকর। এর সঙ্গে অনেক সময় কারও হাত-পা অবশ হয়ে আসে, কামড়ায়, ব্যথা করে ও ঘুম হয় না। ডাক্তারি পরিভাষায় এই সমস্যাকে বলে ‘পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি’। হাতের চেয়ে পায়ে এই রোগের প্রকোপ বেশি হয়। সমস্যা জটিল হলে অনেক সময় পায়ের অনুভূতি কমে যায়; পা থেকে স্যান্ডেল খুলে গেলেও রোগী টের পায় না।
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি অনেক কারণেই হতে পারে; তার মধ্যে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, কিডনি রোগ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ভিটামিনের অভাব অন্যতম।
প্রিগাবালিন, এমিট্রিপটাইলিন ও ভিটামিন বি এই রোগের চিকিৎসায় খুবই কার্যকর। পাশাপাশি ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পারকিনসন রোগ
অকারণে হাত-পা কাঁপা, হাঁটাচলা ধীর হয়ে যাওয়া, শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পারা ইত্যাদি পারকিনসন রোগের লক্ষণ। পারকিনসন সাধারণত প্রৌঢ় বয়সের রোগ, তবে কিছু ক্ষেত্রে অল্প বয়সেও পারকিনসন হতে পারে।
হাঁটাচলা ধীর হয়ে যাওয়া, কথার জোর কমে যাওয়া, লেখার আকার ছোট ও গতি কমে যাওয়া, হাত অথবা পা কাঁপা, হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া, ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারা পারকিনসন রোগের লক্ষণ। এ ছাড়া স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া ও অস্থিরতা-দুশ্চিন্তা ইত্যাদিও পারকিনসন রোগে দেখা যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারকিনসন রোগের কারণ অজানা। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মস্তিষ্কে প্রদাহ (এনসেফালাইটিস), স্ট্রোক ইত্যাদি কারণে পারকিনসন হতে পারে। অল্প বয়সে কারও পারকিনসন দেখা দিলে ‘উইলসন ডিজিজ’ নামক একটি রোগের কথাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
পারকিনসন নিরাময়যোগ্য রোগ না, তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এই রোগের চিকিৎসা শুরুর পূর্বে রোগীর সঙ্গে এই রোগের লক্ষণ, চিকিৎসার প্রক্রিয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও দীর্ঘমেয়াদি ভালো থাকার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। ডোপামিন জাতীয় ওষুধ এই রোগের চিকিৎসায় খুবই কার্যকর। নিয়মিত ব্যায়াম পারকিনসন রোগকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম
অনেক মানুষ আছে রাতে ঘুমের মাঝে অকারণে পা নাড়ে, যা তার নিজের ও সঙ্গে যারা থাকে, তাদের ঘুমের সমস্যা তৈরি করে। ডাক্তারি পরিভাষায় এই সমস্যাকে বলে ‘রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম’।
এই রোগে আক্রান্তরা হাঁটাচলার সময় ভালোই থাকে। কিন্তু যখন বসে বা শুয়ে থাকে, তখন পায়ের মাঝে অস্বস্তি শুরু হয়, আবার পা নাড়ালে বা হাঁটাচলা করলে কমে যায়। সমস্যাগুলো সকালের দিকে কম থাকে, বিকেলে বা রাতে বেড়ে যায়।
রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের চিকিৎসাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—
পরামর্শ: রাতে ঘুমানোর আগে গোসল করে ঘুমানো ভালো। পায়ে টাইট মোজা বা ‘ইলাস্টিক স্টকিংস’ পরে ঘুমালে এই সমস্যা কমে থাকে। টাইট মোজা না পেলে পায়ের ওপর ভারী কম্বল দিয়ে রাখতে পারেন।
ওষুধ: ডোপামিন জাতীয় ওষুধ এই রোগের চিকিৎসায় খুবই কার্যকর। অনেক সময় চিকিৎসকেরা এর সঙ্গে ক্লোনাজিপাম জাতীয় ওষুধও ব্যবহার করে থাকেন।
কারণের চিকিৎসা: রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম থাকলে এর পেছনে কোনো কারণ আছে কি না, খুঁজে দেখতে হবে। রক্তশূন্যতা, কিডনি রোগ বা পারকিনসনের মতো রোগের সঙ্গে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের যোগ আছে। প্রথমে কারণের চিকিৎসা করতে হবে, তাহলে অকারণে পা নাড়ানোর এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
বেলস পালসি
হঠাৎ একদিন আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠলেন, মনে হচ্ছে মুখের এক পাশ বেঁকে গেছে। হাসতে গেলে ঠোঁট উদ্ভটভাবে বেঁকে যাচ্ছে, চোখ ঠিকমতো বন্ধ করতে পারছেন না, পানি খেতে গেলে ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। এই রোগের নাম বেলস পালসি। মুখের পেশিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে যে ফেসিয়াল নার্ভ বা স্নায়ু, তাতে সমস্যা হলে এই রোগ হয়। মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে মুখ অবধি ফেসিয়াল নার্ভের একটি দীর্ঘ পথ আছে, এর যেকোনো এক জায়গায় সমস্যা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ফেসিয়াল নার্ভ। অনেক সময় এর পেছনে ভাইরাস সংক্রমণের হাতও থাকে।
বেলস পালসি হলে দ্রুত নিউরোলজি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত, দেরি হলে চিকিৎসার সুফল কম পাওয়া যেতে পারে। অ্যান্টিভাইরাল ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করার পর ফিজিওথেরাপি হলো মূল চিকিৎসা।
টোসিস
কখনো কখনো আকস্মিকভাবে এক চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। চেষ্টা করেও আর ওই চোখের পাতা খোলা যায় না। এই সমস্যার নাম টোসিস। তৃতীয় ক্রেনিয়াল নার্ভে সমস্যা দেখা দিলে এই রোগ হয়। মস্তিষ্কের টিউমার, স্ট্রোক থেকে শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, চোখের অন্তর্গত পেশির সমস্যা ইত্যাদি হলো এর কারণ। কারণটি নির্ণয় করা জরুরি। তারপর সে অনুযায়ী চিকিৎসা। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস যেহেতু এ ধরনের স্নায়ুগত জটিলতা সৃষ্টি করে, তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
ডা. নাজমুল হক: সহকারী অধ্যাপক (নিউরোলজি), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, ঢাকা