কেন প্রয়োজন লাভ হরমোন?

প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় প্রাণ খুলে হাসলে আনন্দ হয়। পছন্দের গান শুনলে, সকালের রোদে হাঁটতে গেলে বা বিকেলে মাঠে খেলাধুলা করলে আমাদের মন ফুরফুরে লাগে। আবার ছোট শিশুকে আদর করলে স্নেহের অনুভূতি হয়। ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যে থাকলে সুখানুভূতি হয়। এই যে বিভিন্ন আবেগ—এগুলো কি সব শরীরের জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া?

আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দ অনুভূতি সৃষ্টিতে কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব আছে
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দ অনুভূতির ওপর কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব আছে। সাধারণ ভাষায় এগুলোকে বলে ‘হ্যাপি হরমোন’। আনন্দের অনুভূতির সময় এই হরমোনগুলো বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়। এসব হরমোন নিঃসৃত হলে আনন্দের অনুভূতির মাত্রা বেড়ে যায়। হ্যাপি হরমোন মূলত চারটি—ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন ও এনডরফিন। এই লেখায় ডোপামিন ও অক্সিটোসিন—এই দুটি হরমোন নিয়ে আলোচনা করা হবে। শুধু আবেগ-অনুভূতির ওপরেই নয়, এই হরমোনগুলো নিউরো-ট্রান্সমিটার হিসেবে শরীরে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। যেমন হাঁটাচলার গতি, ছন্দ নির্ধারণ ও ভারসাম্য রক্ষা, মনোযোগ ও স্মৃতিগঠন, খাদ্য পরিপাক ইত্যাদি। স্কিজোফ্রেনিয়া, পারকিনসন রোগের পেছনে ডোপামিন ও সেরোটোনিনের অনুপাতের অসামঞ্জস্য দায়ী।

ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতা তৈরিতে ডেপামিন

হ্যাপি হরমোনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হরমোন হলো ডোপামিন। কোনো ভালো লাগা বা আনন্দের কাজ করার পর মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ বহুগুণে বেড়ে যায়। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কে সুখানুভূতি তৈরি হয়। যেমনটি হয় প্রাণ খুলে হাসলে, পছন্দের খাবার খেলে, গান শুনলে, প্রিয় মানুষের সাহচর্যে গেলে, প্রিয় দল খেলায় জিতলে কিংবা অফিসে বস এবং সহকর্মীর প্রশংসা পেলে। এই ইতিবাচক অনুভূতিগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের কর্মোদ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন অফিসে প্রশংসা পেলে সেই কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। সেই কাজে নিজের দক্ষতার ওপর আত্মবিশ্বাস বাড়ে ও কাজটি ভবিষ্যতে আবার করার সুযোগ পেলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এটিকে বলা যায় ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেম, যা আমাদের দক্ষতা তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। বিষণ্নতায় দেহের ডোপামিনের মাত্রা অনেক কমে যায়। এ কারণে বিভিন্ন নেতিবাচক লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন কাজে অনাগ্রহ, আনন্দবোধ হারানো, নিদ্রাস্বল্পতা অথবা অতিনিদ্রা, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি।

কোনো ভালো লাগা বা আনন্দের কাজ করার পর মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ বহুগুণে বেড়ে যায়
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

কেন প্রয়োজন লাভ হরমোন?

অক্সিটোসিনের অপর নাম লাভ হরমোন। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে তৈরি হয়ে পিটুইটারি গ্রন্থির পেছনের অংশে জমা থাকে এবং প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে নিঃসৃত হয়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হলে মস্তিষ্কে ডোপামিন আর সেরোটোনিনের পাশাপাশি অক্সিটোসিনের নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে প্রেমানুভূতি তৈরি হয়। নারীদের শরীরের অক্সিটোসিনের পরিমাণ বেশি থাকে। সন্তান জন্মদানের সময় অক্সিটোসিন প্রচুর পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে জরায়ুর সংকোচন ঘটায়, যা সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করতে সাহায্য করে। আবার সন্তান জন্মের পর স্তন থেকে মাতৃদুগ্ধ নিঃসরণ করায়। শারীরিক সম্পর্কের সময় অক্সিটোসিনের নিঃসরণ হয়, যা সঙ্গীর প্রতি গভীর আস্থা ও ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে। গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইঁদুরছানা জন্মের পর মা ইঁদুরের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন রিসেপ্টরের সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায় ও তাদের মধ্যে মাতৃসুলভ গুণাবলির বিকাশ ঘটে। ছানাগুলোর সফলভাবে বেঁচে থাকা মায়ের মাতৃসুলভ আচরণের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। মানুষের মধ্যেও বিশেষ করে মায়েদের মধ্যে মাতৃসুলভ আচরণের বিকাশ ঘটায়। যেমন বাচ্চাকে কোলে তুলে আদর করা, কোমলভাবে স্পর্শ করা, গান শোনানো। এভাবে অক্সিটোসিন মা ও শিশুর মধ্যে অনন্য বন্ধন গড়ে তোলে।

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হলে মস্তিষ্কে ডোপামিন আর সেরোটোনিনের পাশাপাশি অক্সিটোসিনের নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়
ছবি: পেক্সেলস ডটকম