উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে ৪ ভুল ধারণা
বয়স ৩০ বছর পেরোলেই উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তারপরও এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা চালু আছে। এসব ভুল ধারণার জন্য অনেকে সমস্যাটিকে এড়িয়ে চলতে চান, অনেক সময় যার পরিণাম হয় মর্মান্তিক।
আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা এখনো জানেন না যে তাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং সে জন্য ধীরে ধীরে ভয়ংকর জটিলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, শারীরিক কোনো সমস্যা নেই মানে তার রক্তচাপও স্বাভাবিকই আছে। এত মাপামাপির কী দরকার? কারও কারও ধারণা, মাপতে গেলেই বা ডাক্তারের কাছে গেলেই কোনো না কোনো সমস্যা ধরা পড়ে, এর চেয়ে যেমন চলছে তেমই চলুক। কোনো সমস্যা তো হচ্ছে না।
কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ হলো নীরব ঘাতক। কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ ছাড়াই এটি শরীরে বাসা বাঁধতে পারে এবং দিনে দিনে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হৃৎপিণ্ড, কিডনি, চোখ, রক্তনালি, মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জটিলতা হলো স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত। আকস্মিক স্ট্রোক একজন সুস্থ কর্মক্ষম মানুষকে নিমেষেই শয্যাশায়ী ও পরিবারের বোঝা বানিয়ে দিতে পারে। এই উচ্চ রক্তচাপের জন্য হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকিও বাড়ে। রক্তনালিতে পরিবর্তন ঘটে, রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে বলে গ্যাংগ্রিন ও অন্যান্য জটিলতা হয়। হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি ও রেটিনায় রক্তপাতের কারণে হতে পারে চিরস্থায়ী অন্ধত্ব।
আরেকটি মারাত্মক জটিলতা হলো কিডনি ফেইলিউর। সারা বিশ্বে কিডনি অকার্যকারিতার অন্যতম প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ। তাই সমস্যা হচ্ছে না বলে রক্তচাপ মাপবেন না, তা হয় না। বয়স ৩০ পেরোলেই নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে। বছরে একবার বা দুবার। এ ছাড়া যতবারই কোনো প্রয়োজনে কোনো চিকিৎসকের কাছে যাবেন, ততবারই নিজের রক্তচাপ মেপে নিন।
১. বয়স বাড়লে রক্তচাপ একটু বাড়বেই
অনেকের ধারণা, বয়স বাড়ছে, এখন তো রক্তচাপ একটু বাড়ন্তই পাওয়া যাবে। তাই বলে ওষুধ খেতে হবে কেন? কথাটা আংশিক সত্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রক্তনালিগুলো স্থিতিস্থাপকতা হারায়, ফলে রক্তচাপ বাড়তে থাকে। বলা হয়, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরই উচ্চ রক্তচাপ থাকার কথা। এখন চিকিৎসা কেন নেবেন? কারণ, আগেই বলেছি উচ্চ রক্তচাপ হলো নীরব ঘাতক। সবার জন্য আদর্শ রক্তচাপ হলো সিস্টোলিক ১২০ মিমি আর ডায়াস্টোলিক ৭০ মিমি পারদ। তবে বেশির ভাগ উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জন্য ভালো টার্গেট বা কাঙ্ক্ষিত রক্তচাপ হলো সিস্টোলিক ১৩০ ও ডায়াস্টোলিক ৭০ মিমি পারদের মধ্যে রাখা। কেন? যদি এই মাত্রায় রক্তচাপ রাখতে পারেন, তাহলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে ৫০ শতাংশ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে ২৫ শতাংশ, হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি কমে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ আর কিডনি অকার্যকারিতার ঝুঁকিও কমে ৫০ শতাংশের মতো। একই সঙ্গে কমে গ্যাংগ্রিন, অন্ধত্ব ও স্মৃতিভ্রষ্টতার ঝুঁকি। অর্থাৎ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি একই সঙ্গে এতগুলো রোগকে প্রতিহত করতে পারছেন। ঠিক এ জন্যই যেকোনো বয়সেই উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা জরুরি।
২. চিকিৎসা মানেই কি ওষুধ
আমাদের আরেকটি ভুল হলো আমরা ধরেই নিই যে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা মানে সারা জীবন একটি কি দুটি ওষুধ খেতে থাকা। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার একটি বড় অংশ যে লাইফস্টাইল বা জীবনযাত্রার পরিবর্তন, তা আমরা ভুলে যাই। এমনও হতে পারে যে প্রথম প্রথম বেশ কয়েক বছর কারও শুধু জীবনযাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আবার ভালোভাবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন বজায় রাখতে পারলে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনাও সম্ভব। কেমন হওয়া উচিত একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জীবনাচরণ?
১. ওজন বাড়তি থাকলে কমানোর চেষ্টা করুন। উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ওজন বজায় রাখুন।
২. লবণ খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনুন। বাড়তি লবণ খাবেন না, দিনে ছয় গ্রামের বেশি লবণ নয়। কিছু খাবারে গোপন লবণ লুকিয়ে থাকে, যেমন সস, কেচাপ, চিপস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, সালাদ ড্রেসিং, মেয়নেজ ইত্যাদি। এগুলোও এড়িয়ে চলতে হবে। ৩. নিয়মিত হাঁটুন বা শরীরচর্চা করুন। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট কোনো না কোনো ব্যায়াম করুন, যেমন হাঁটা, জগিং, সাঁতার, সাইক্লিং ইত্যাদি।
৪. উচ্চশর্করা ও চর্বিযুক্ত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। তার বদলে গোটা শস্য, ভালো আমিষ, আঁশযুক্ত খাবার ও রোজ যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি, তাজা ফলমূল খান।
৫. ধূমপান বর্জন করুন।
৬. রাতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম খুব জরুরি। বর্তমানে ঘুমকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ, রাতে ঘুমের সময়টি হলো রিপেয়ার টাইম। এ সময় আমাদের শরীর ও মনের মেরামত হয়। তাই দিনের পর দিন ঘুমের ব্যাঘাত শরীর নামের যন্ত্রটিকে অচল করে দিতে পারে।
৭. মানসিক চাপমুক্ত থাকুন, স্ট্রেস কমান।
জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমেই উচ্চ রক্তচাপ অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তারপর আসে ওষুধের প্রসঙ্গ। এখন কার জন্য কোন ওষুধ প্রযোজ্য, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দিন। অনেকেই দোকান থেকে দোকানির পরামর্শে বা পাশের বাসার ভদ্রলোক বা বন্ধু যে ওষুধ খাচ্ছেন, সেটা কিনে এনে খেতে শুরু করেন। মনে রাখবেন, ওষুধ বাছাই করার সময় আপনার বয়স, আনুষঙ্গিক অন্যান্য রোগবালাই ও বিদ্যমান জটিলতা বিবেচনা করা হয়। সব ওষুধ সবার জন্য না।
৩. ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন খেতে হবে
উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হওয়ার পর বেশির ভাগ রোগীর দুঃখ এটাই যে ওষুধ শুরু করলে তো সারা জীবন খেতে হবে!
এ কী যন্ত্রণা! সব সময় কথাটা সত্য নয়। যেমন নারীদের গর্ভাবস্থায় একধরনের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় যা সাধারণত সন্তান প্রসবের ছয় সপ্তাহ থেকে ছয় মাসের মধ্যে সেরে যায়। আবার যাঁরা স্টেরয়েড বা এনএসএআইডি গোত্রের ওষুধ সেবন করছেন, তাঁদের হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে যা ওই ওষুধ বন্ধ করার পর স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। কিছু হরমোনজনিত রোগে, যেমন থাইরয়েডের রোগ বা কুশিং সিনড্রোম, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির সমস্যায় রক্তচাপ বাড়তে পারে যা ওই রোগ নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবার কমে যায়। কিডনির রোগ যেমন কিডনির প্রদাহে রক্তচাপ বাড়ে, পরে রোগ সেরে গেলে কমে আসতে পারে।
কিন্তু এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। ৯০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপের রোগীর আসলে সারা জীবনই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। তবে এ নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। আমরা ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য যেমন খাবার খাই, এই ব্যাপারটাও তেমন। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করা জীবনযাপনের অংশ হিসেবে ধরে নিতে হবে।
৪. অল্প বয়সে কি উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে
উচ্চ রক্তচাপ কেবল বয়স্কদের রোগ নয়। অল্প বয়সে, এমনকি শিশু-কিশোরদেরও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। বর্তমানে ৩০ বছর বয়সের আগেই উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ স্থূলতা। আবার যাঁরা স্থূলতা বা ওবেসিটিতে ভুগছেন, তাঁরা একই সঙ্গে স্লিপ এপনিয়াতেও ভোগেন। এই রোগে রাতে ঘুমের মধ্যে শ্বাসের সমস্যা হয় ও অক্সিজেনের মাত্রা কমে আসে। এদের উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। ওজন কমানোর মাধ্যমে এই রোগেরও সমাধান সম্ভব। অল্প বয়সে হরমোনজনিত রোগ ও কিডনি রোগ উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। অনেক কিডনি রোগ জিনগত থাকতে পারে। তাই অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সচেতন হতে হবে সবাইকে। উপসর্গ থাকুক আর না থাকুক, নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে। রক্তচাপ বাড়লে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, মাঝেমধ্যেই তা মেপে দেখতে হবে। তাহলেই আপনি এর জটিলতাগুলো প্রতিহত করতে পারবেন।
লেখক: অধ্যাপক আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, পরিচালক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা