ক্যানসারে আক্রান্ত নুজহাত সুস্থ হয়ে অন্য রোগীদের সাহস জোগাচ্ছেন

অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস। এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে ‘এভরি স্টোরি ইজ ইউনিক, এভরি জার্নি ম্যাটারস’ (প্রতিটি গল্প অনন্য, প্রতিটি যাত্রা গুরুত্বপূর্ণ)। সত্যিই তো, প্রতিটি জীবনের গল্পই আলাদা। প্রতিটি লড়াই অন্য রকম। এক লড়াকু নারীর স্তন ক্যানসার জয়ের গল্প নিয়ে আজকের আয়োজন।

ক্যানসারের চিকিৎসাপর্ব শেষে নুজহাত তারান্নুমছবি: নুজহাত তারান্নুমের সৌজন্যে

সংসার, একমাত্র সন্তান আর নিজের বুটিক টি’স নিয়ে দারুণ কাটছিল নুজহাত তারান্নুমের জীবন। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে হঠাৎ একদিন স্তনে একটি চাকা অনুভব করলেন। দ্রুতই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেন।

বায়োপসির রিপোর্ট থেকে জানা গেল, নির্দোষ সিস্ট। তিন-চার মাস পর চাকাটির আকার বাড়তে থাকলেও তিনি দুশ্চিন্তা করেননি। কারণ, চিকিৎসক অভয় দিয়েছিলেন।

যখন জানলেন ক্যানসার

চাকাটি বড় হতে থাকলে পরের বছর এপ্রিলে আবার গেলেন চিকিৎসকের কাছে। আবারও বায়োপসি করা হলো। ধরা পড়ল ক্যানসার। প্রথমেই নুজহাতের মনে হলো, তিনি না থাকলে ১৪ বছর বয়সী তাঁর একমাত্র ছেলের কী হবে!

চিকিৎসা নেওয়া তো বটেই, নিজের মনটাকে স্বাভাবিক করে তোলাও হয়ে দাঁড়াল এক চ্যালেঞ্জ। তবে পরিবারের সবাই পাশে ছিলেন। ক্যানসারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য গেলেন সিঙ্গাপুর। সেখানে জানলেন, স্টেজ ২বি, মানে প্রায় তৃতীয় পর্যায়ে চলে গেছে ক্যানসার।

আরও পড়ুন

বড় কঠিন সে চিকিৎসা

ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালেও নিজে শক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন নুজহাত
ছবি: নুজহাত তারান্নুমের সৌজন্যে

সিঙ্গাপুরেই কেমোথেরাপি শুরু করলেন। দেশে ফিরে কেমোথেরাপির বাকিটা বিআরবি হাসপাতালে শেষ করলেন। ২১ দিন অন্তর কেমোথেরাপি দিতে হতো। কেমোথেরাপির পর প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

পরে সিঙ্গাপুরেই হলো শল্যচিকিৎসা ও রেডিওথেরাপি। চিকিৎসার সময় কখনো ভালো থেকেছেন, কখনো খারাপ, কখনো আবার বেশি খারাপ। কখনো কখনো মনে হতো, আজকের দিনটা তো পার হোক!

কোনো দিন হয়তো কেবল খাবার খেতে পারাটাই হয়ে দাঁড়াত লক্ষ্য, কোনো দিন একটু হাঁটতে পারাটাই হতো বিশাল সাফল্য। আবার পরচুলা পরে একটু বাইরে যেতে পারলে সেটিই হতো সারা দিনের আনন্দ।

ছোট ছোট লক্ষ্য

চিকিৎসা শেষে ক্যানসার রোগীদের জন্য কিছু করার ভাবনা থেকে তিশক্যানের যাত্রা শুরু
ছবি: নুজহাত তারান্নুমের সৌজন্যে

এভাবে ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিন পার করায় নুজহাত তুলনামূলক কম কষ্ট অনুভব করেছেন। অসুস্থ হয়ে কী পারছেন না, সেটি না ভেবে বরং কী পারছেন, সেটিই ভাবতেন। নুজহাত বলেন, ‘যেকোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য বদলে যায়। অসুস্থ অবস্থায় আমি জার্নাল লিখতে শুরু করি।

কোন সময় কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা–ও লিখে রাখতাম। না–বলা কথা লিখতে পেরে মনের ভার কমে যেত। যখন বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না, তখনো ইতিবাচকভাবে ভাবতে চেষ্টা করতাম। যদিও এ অবস্থায় নিজেকে দেখাটাই কঠিন, তবু উপলব্ধি করেছিলাম, মনের জোর না থাকলে শরীর এই ধকল সইতে পারবে না।’

সে সময় ছেলেকেও সাহস জোগাতেন, বলতেন, ‘মনে কোরো না যে মা মারা যাবে।’ পরে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই ভাবলেন, চিকিৎসা শেষে ক্যানসার রোগীদের জন্য কিছু করবেন।

আরও পড়ুন

শুরু হলো তিশক্যান

তিশক্যান উদ্যোগ থেকে ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন এখন
ছবি: নুজহাত তারান্নুমের সৌজন্যে

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চিকিৎসা শেষ হলো। সে বছরই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘তিশক্যান’। তাঁর ডাকনাম তিশনা থেকে ‘তিশ’ আর ক্যানসার এবং তা জয় করতে পারা (ক্যান) থেকে ‘ক্যান’। এই উদ্যোগ থেকে ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন এখন। এরই মধ্যে বেশ কিছু আয়োজন করেছে তিশক্যান।

ক্যানসার রোগীদের মানসিক সমর্থন জোগাতে কিছু সেশন হয়েছে, আয়োজন করা হয়েছে মেলা। মেলার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা দিয়েছেন পুরোনো কিন্তু ব্যবহারযোগ্য জিনিস, কেউ কেউ দিয়েছেন আর্থিক অনুদান। এই অনুদান এবং মেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেওয়া হয়েছে কোনো ক্যানসার রোগীকে।

ক্যানসার রোগীদের জন্য কাজ করতে গিয়ে নুজহাত দেখেছেন, কম বয়সী নারীদেরও স্তন ক্যানসার হচ্ছে। নিয়ম করে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখাটা যে কত জরুরি, সে বিষয়ে তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন।

তিনি আরও দেখেছেন, বহু নারীই পরিবারের সদস্যদের কাছে নিজের সমস্যার কথা বলতে লজ্জা পান, কেউ আর্থিক ভাবনায় সংকোচ করেন। কিন্তু সমস্যা চেপে রাখার এই প্রবণতার কারণে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তাই সমস্যা ‘ছোটখাটো’ মনে হলেও চেপে রাখা কখনোই উচিত নয়, মনে করেন এই লড়াকু নারী।

আরও পড়ুন