হঠাৎ কেউ অচেতন হলে কী করবেন

রাস্তাঘাটে, বাড়িতে বা কর্মস্থলে হঠাৎ আপনার সামনে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এ সময় প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে অনেক সময় বড় বিপদ এড়ানো যায়।

অজ্ঞান হওয়ার আগে বমি বমি লাগে, মাথা ঘোরে
ছবি : প্রথম আলো

অজ্ঞান হওয়ার আগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফ্যাকাশে ভাব দেখা যায়, বমি বমি লাগে, মাথা ঘোরে, প্রচুর ঘাম হয়, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, কান শোঁ শোঁ করে, পাশাপাশি বেড়ে যেতে পারে হাই তোলা, দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন।

এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে অজ্ঞান হওয়া ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন দাঁড়ানো থাকলে দ্রুত বসিয়ে বা শুইয়ে দিতে হবে। মাথা হার্টের চেয়ে সামান্য নিচে রাখতে হবে, পা উঁচু করে শোয়াতে হবে।

অজ্ঞান দশা সাধারণত কয়েক মিনিট থাকে। জ্ঞান ফেরার পর মাথাব্যথা, ভুলে যাওয়া ও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। বেশির ভাগ সময়ই এটি গুরুতর কিছু নয় এবং দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ছাড়াই রোগী খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

কেন হয়

গরমের কারণে হিটস্ট্রোক হতে পারে
ছবি: পেক্সেলস

অজ্ঞান হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ হলো—

  • রক্তে সুগারের পরিমাণ কমে যাওয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া।

  • পানিশূন্যতা।

  • হিটস্ট্রোক।

  • খিঁচুনি।

  • ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (টিআইএ), যাকে মিনি স্ট্রোকও বলা যায়।

  • সিনকোপ (মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়া)।

  • একটানা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে।

  • খুব জোরে অনেকক্ষণ শ্বাস নিলে।

  • মৃগীরোগ।

  • রক্তে বিভিন্ন ধরনের লবণের স্বল্পতা।

এ ছাড়া প্রাণঘাতী কিছু কারণ, যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, মাথায় আঘাত, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা মেজর স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা হার্টের গতির অস্বাভাবিকতা, ওষুধের ডোজ কমবেশি হলে, এমনকি বিষাক্ত মদ্যপানেও প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে রোগী অজ্ঞান হতে পারে। হৃদ্‌যন্ত্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়ে কোনো ব্যক্তির যখন ক্যারোটিড পালস থাকে না বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় তখনো রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। গলায় কিছু আটকে শিশুরা জ্ঞান হারাতে পারে। অনেক সময় প্রচণ্ড মানসিক চাপ বা আঘাতেও এমনটা হয়। কিছু মানুষ বিনা কারণে বা সতর্কীকরণ লক্ষণ ছাড়াই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন

কী করবেন

প্রথমেই ধারালো বস্তু, আগুনের উৎস ইত্যাদি বিপজ্জনক জিনিস থেকে রোগীকে দূরে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব জরুরি সেবা নম্বরে ফোন করতে হবে। অনেক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস আছে, যাদের ফোন করলে দ্রুতই চলে আসে। এমন কয়েকটি নম্বর সব সময় সংগ্রহে রাখা উচিত। একই সঙ্গে রোগী শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে কি না লক্ষ করুন। বুকের ওঠানামা দেখলেই এটা বোঝা যাবে। আঁটসাঁট কাপড় পরা থাকলে খুলে দিতে হবে বা ঢিলা করে দিতে হবে। শ্বাস বন্ধ থাকলে মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস দিতে হবে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তখনই সিপিআর শুরু করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি এ সময় শ্বাস না–ও নিতে পারে বা শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক হতে পারে। অনেক কারণেই কোনো ব্যক্তি অজ্ঞান হতে পারে। তবে শুধু ক্যারোটিড পালস না থাকলেই বুঝতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আছে এবং সিপিআর দিতে হবে।

যতটা সম্ভব ভিড়ভাট্টা কমাতে হবে। জুতা শোঁকানো, মাথায় পানি ঢালা, পায়ে তেল মালিশ করার মতো কাজ না করে অভিজ্ঞ একজন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে হবে।

অজ্ঞান ব্যক্তিকে ভালোভাবে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। তাহলে মুখ ও গলায় লালা থাকলে বেরিয়ে আসবে। শিশুদের ক্ষেত্রে গলায় কিছু আটকে আছে কি না দেখতে হবে।

আজকাল প্রায় সব বাড়িতেই রক্তচাপ মাপার যন্ত্র থাকে
ছবি: প্রথম আলো

রক্তে শর্করা কমে গেছে কি না, গ্লুকোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কমে গেলে রোগীর জ্ঞান থাকলে বা ডাকে সাড়া দিলে চিনিজাতীয় খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। নতুবা দেরি না করে শিরাপথে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্লুকোমিটার না থাকলেও যদি মনে হয় রক্তে শর্করা কমে গেছে, তাহলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু অজ্ঞান রোগীকে কোনো শরবত বা খাবার দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কারণ, সেই খাবার বা পানি ফুসফুসে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে ওষুধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রোগীকে নিয়মিত খাবার এবং হালকা নাশতা খেতে দিতে হবে।

আজকাল প্রায় সব বাড়িতেই রক্তচাপ মাপার যন্ত্র থাকে। রক্তচাপ খুব কম হলে বা পাওয়া না গেলে পায়ের দিকটা একটু উঁচু করে ধরতে হবে বা পায়ের নিচে বালিশ দিতে হবে।

রোগীর খিঁচুনি শুরু হলে আতঙ্কিত না হয়ে এক পাশে কাত করে দিতে হবে। মুখে চামচ বা এ–জাতীয় জিনিস ঢোকানোর চেষ্টা করা যাবে না। জোর করে ধরে খিঁচুনি থামানো বা নাকের কাছে বিভিন্ন জিনিস শোঁকানোর কোনো প্রয়োজন নেই। মৃগীরোগীদের নিয়মিত ওষুধ সেবন জরুরি।

বড় ধরনের স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতেও রোগী অজ্ঞান হয়। অনেক সময় মস্তিষ্কের রক্তনালি খুব অল্প সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে আবার খুলে যায়। তখন রোগী সাময়িক সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়। একে বলে ট্রানজিয়েন্ট ইশকেমিক অ্যাটাক (টিআইএ)। এটি একটি জরুরি সংকেত। কারণ, অতি অল্প সময়েই রোগী বড় ধরনের স্ট্রোকের সম্মুখীন হতে পারে। এ জন্য প্রাথমিক পরিচর্যা শেষে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে অজ্ঞান হওয়ার কারণ জানা ও চিকিৎসা করা জরুরি।

আরও পড়ুন

গরমের সময় হিটস্ট্রোকও কিন্তু অচেতন হওয়ার একটি কারণ। হিটস্ট্রোকে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই গরমের এ সময়টায় আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। গরমের দিনে কিছু নিয়ম মেনে চললে হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচা যায়। এ সময় ঢিলেঢালা হালকা রঙের সুতি কাপড় পরা ভালো। যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকতে হবে। রোদে বাইরে যাওয়ার সময় ক্যাপ অথবা ছাতা ব্যবহার করা উচিত। প্রচুর পানি বা খাওয়ার স্যালাইন অথবা ফলের রস পান করতে হবে। গ্রীষ্মকালে তীব্র শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলতে হবে। হিটস্ট্রোকের পূর্বলক্ষণগুলো দেখা দিলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগীকে অপেক্ষাকৃত শীতল কোনো স্থানে নিয়ে যেতে হবে। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। ফ্যান ছেড়ে দিতে হবে বা বাতাস করতে হবে। প্রচুর পানি বা খাওয়ার স্যালাইন পান করতে হবে। কাঁধে-বগলে অথবা কুঁচকিতে বরফ দেওয়া যেতে পারে। পাতলা পায়খানা বা বমি হলে পানিশূন্যতা ও লবণস্বল্পতা এড়াতে বারবার স্যালাইন খেতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

স্যালাইন পানি শরীর চাঙা রাখে
মডেল: রিয়া বর্মণ। ছবি: কবির হোসেন

এ ছাড়া অজ্ঞান হওয়ার ঝুঁকি কমাতে বিশেষ করে ভিড় বা গরম জায়গায় এক অবস্থানে বেশি সময় ধরে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে কাউন্সেলিং সাহায্য করতে পারে। হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।

অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন। কারণ, এতে পানিশূন্যতা ও নিম্ন রক্তচাপ হতে পারে।

নিয়মিত ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় অজ্ঞান হওয়া খুবই বিপজ্জনক। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মা ও গর্ভস্থ সন্তান, দুজনেরই ক্ষতি হতে পারে।

যদি কেউ ঘন ঘন অজ্ঞান হতে থাকে, সঙ্গে মাথাব্যথা, বমি, বুকব্যথা বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, তাহলে দ্রুততম সময়ে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা দিলে বেশির ভাগ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

ডা. মধুরিমা সাহা, সহকারী অধ্যাপক, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা

আরও পড়ুন