সব মাথাব্যথাই কি মাইগ্রেন, নাকি অন্য কিছু?

প্রথম আলোর নিয়মিত স্বাস্থ্যবিষয়ক আয়োজনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হয় অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান ‘মাথা নিয়ে মাথাব্যথা’র দ্বিতীয় পর্ব। এবারের আলোচনার বিষয় ছিল ‘মাথাব্যথা: মাইগ্রেন, নাকি অন্যকিছু?’

‘মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা সচেতনতা সপ্তাহ ২০২২’ উপলক্ষে জরুরি এ বিষয় নিয়ে আলোচনার সময়োপযোগী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সার্বিক সহযোগিতা করেছে স্বনামধন্য ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এসকেএফের মাইগ্রেনসহ অন্যান্য মাথাব্যথানাশক ওষুধ টাফনিল, ডিটান জেনেরিক উপাদানযুক্ত প্রথম মাইগ্রেন চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ লাসমি এবং মাইগ্রেনের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে কার্যকর ওষুধ নোরিয়াম।

এবারের আলোচনার বিষয় ছিল ‘মাথাব্যথা: মাইগ্রেন, নাকি অন্যকিছু?’
ছবি: সংগৃহীত

আলোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন নাদিয়া নিতুল। আলোচক হিসেবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী ও জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী তানভীন সুইটি।

নাদিয়া নিতুল শুরুতেই ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে জানতে চান, মাথাব্যথা আসলে কী কী কারণে হয় এবং সব মাথাব্যথাই মাইগ্রেন নির্দেশ করে কি না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে মাথাব্যথার দুটি ধরন রয়েছে। একটি শুধুই মাথাব্যথাজনিত রোগ। যেমন: মাইগ্রেন, টেনশনটাইপ মাথাব্যথা, ক্লাস্টার হেডেক ইত্যাদি। আবার অনেক সময় মাথাব্যথা অন্য কোনো রোগের নির্দেশক হিসেবেও কাজ করে৷ চোখ, দাঁত, সাইনাস ইত্যাদির সমস্যায় মাথাব্যথা হয়। মস্তিষ্কের রোগ, টিউমার বা অতীতের তীব্র আঘাতের কারণেও মাথাব্যথা হতে পারে। তাই কেউ মাথাব্যথার অভিযোগ নিয়ে এলেই চিকিৎসক আগে তা কোন ধরনের মাথাব্যথা, তা নিরূপণের চেষ্টা করেন। মাইগ্রেনও প্রাইমারি মাথাব্যথা।’ এটি মারাত্মক বা প্রাণঘাতী কোনো রোগ নয়, কিন্তু এতে যাঁরা ভোগেন, তাঁরা খুবই কষ্ট পান। সে ক্ষেত্রে ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘জীবনযাপন ও মেডিকেল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর চিকিৎসা করতে হয়৷’

এ পর্যায়ে অভিনেত্রী তানভীন সুইটি জানান, তিনি নিজেই মাইগ্রেনের সমস্যায় কষ্ট পান। এ জন্য তিনি কর্মজীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। অতিরিক্ত রোদ বা টানা রাত-দিন ধরে পরিশ্রমের ফলে তিনি মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বমিও হতো। ক্যারিয়ারের ব্যস্ত সময়ে তিনি সব সময় ব্যাগে মাইগ্রেনের ওষুধ রাখতেন। ব্যথা ওঠার উপক্রম হলেই তিনি তা সেবন করতেন।

ডা. মো. তৌহিদুল বলেন, ‘মাইগ্রেনের কিছু ট্রিগার থাকে, যার ফলে মাথাব্যথা শুরু হয়৷ এগুলো বিভিন্নজনের জন্য বিভিন্ন রকম হতে পারে। অতিরিক্ত স্ট্রেস, ঘুম ও খাওয়ার অনিয়ম, উচ্চ শব্দ, অতিরিক্ত আলো, টানা পরিশ্রম, দীর্ঘ সময় ধরে মুঠোফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার এমনকি কোনো কোনো খাবার ও পানীয়ের প্রভাবে মাইগ্রেনের অ্যাটাক শুরু হতে পারে। সে সময় রোগীর মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমি বা বমি ভাব, শব্দ ও আলোক সংবেদনশীলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। তীব্র মাথাব্যথা শুরু হওয়ার আগে থেকেই রোগী বুঝতে পারেন অ্যাটাক হবে। অনেক সময় চোখে ঝাপসা বা আলোর ঝলক দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি ঘটে। মাইগ্রেন ডায়াগনোসিস হলে ট্রিগারগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাপনে পরিবর্তন আনলে মাইগ্রেনের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। স্বস্তির কথা হলো, এই রোগটি যতই কষ্টদায়ক হোক না কেন, এতে বড় কোনো দৈহিক ক্ষতি হয় না।

মাইগ্রেন ছাড়া অন্য কোনো কারণে মাথাব্যথা হচ্ছে কি না, তা কীভাবে বোঝা যাবে? উত্তরে ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মাইগ্রেনের ব্যথার ধরন দেখে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা চেনা যায়। তবে বেশি বা কম বয়স্ক রোগী হলে, অতিরিক্ত ও টানা বহুদিন মাথাব্যথা হলে তখন সাবধানে রোগ নির্ণয় করার পদক্ষেপ নেন চিকিৎসকেরা। ফান্ডোস্কপি দিয়ে মস্তিষ্কের প্রেশার মাপার মতো পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও রোগীর ইতিহাস ও শারীরিক লক্ষণের রেকর্ড রাখা হয় এ ক্ষেত্রে৷ সন্দেহ থাকলে বিশেষ ক্ষেত্রে এমআরআই, সিটি স্ক্যান ইত্যাদিসহ রক্ত পরীক্ষা, মস্তিষ্কে ইনফেকশন আছে কি না তা দেখা ইত্যাদি সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এভাবে সঠিক ডায়াগনোসিস করে সেকেন্ডারি মাথাব্যথার সঠিক ও সময়োপযোগী চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।’

তানভীন সুইটি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মডেলিং দিয়ে। সে সময় কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক রকম টেনশনে ভুগতেন। আবার এখন সমাজকর্মে যুক্ত হওয়ার পর অনেক সমস্যা তাকে হতাশা, কষ্ট ও অ্যাংজাইটিতে ভোগায়। সমাজের এই সমস্যাগুলো মাইগ্রেন ট্রিগার হিসেবে খুবই কমন। এক রোগীর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ডা. মো. তৌহিদুল বলেন, ‘আবহাওয়ার তারতম্যের জন্য মাথাব্যথা হতে পারে। অতিরিক্ত গরম ও ঠান্ডায় মাথাব্যথা হলে তা মাইগ্রেনেরই এক রূপ এবং ব্যথা শুরু হলে টাফনিলের মতো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হবে। মাথাব্যথার সঙ্গে চোখে–নাকে ফোলা ভাব থাকলে এবং নাক বন্ধ থাকলে সাইনাসের এক্স–রে করা উচিত৷ ধুলা বা অন্য কিছুতে অ্যালার্জি আছে কি না তা দেখতে হবে।’

আরেকজন রোগী জানতে চান, মাইগ্রেনের ওষুধ গর্ভাবস্থায় সেবন করা যাবে কি না। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তরে ডা. মো. তৌহিদুল বলেন বলেন, ‘গর্ভবতী হওয়ার প্রথম দিকে খুবই সাবধানে ওষুধ খেতে হয় এবং সব ওষুধ গর্ভাবস্থায় খাওয়া যাবে না।’ এ সময় নাদিয়া নিতুলের কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গর্ভাবস্থায় কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না।’

আরেকজন দর্শক মাথাব্যথা হলে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শুধু ঘুমের ওষুধে এতে কোনো লাভ হবে না। মাইগ্রেনের কোনো কোনো ওষুধে ঘুম আসে। তবে সেগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে সেবন করতে হবে।’

মাইগ্রেনের ব্যথা একেবারে সেরে যায় না। তবে জীবনযাপনে অনিয়ম এড়ালে, সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিলে একজন মাইগ্রেন–রোগী স্বাভাবিক ও কোয়ালিটি লাইফ কাটাতে পারেন বলে মত দেন মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী। তবে এ ক্ষেত্রে স্ট্রেস এড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। রাত জাগার অভ্যাস দূর করতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় বর্জন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ব্যায়াম ইত্যাদির সমন্বয়ে উপযুক্ত লাইফস্টাইল ও সঠিক চিকিৎসা—এই সবকিছু মিলিয়েই মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।