রোজা রেখেও কাদের ওজন কমে না
পবিত্র রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। পুরো এক মাস দীর্ঘ সময় (সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) না খেয়ে থাকার ফলে ওজন কমাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মধ্যেও দেখা যায়, অনেকের রমজান মাস শেষে ওজন বেড়ে যায়। এটার কারণ কী?
মূলত খাদ্যাভ্যাসই এ জন্য দায়ী।
রোজার সময় পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস গ্লুকোজ হোমিওস্টেসিস ও গ্লুকোরেগুলেটরি প্রক্রিয়াগুলোর ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে ভিসেরাল ফ্যাট, রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডস ও কোলেস্টেরল, খালি পেটের ইনসুলিন ও গ্লুকোজের অসামঞ্জস্যের কারণে শরীরে বিপাকক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা দেয়। এ কারণে নানা ধরনের ফলাফল খেয়াল করা যায়। যেমন—
ওজন বেড়ে যাওয়া
গবেষণায় দেখা গেছে, রোজার প্রথম ২ সপ্তাহে প্রায় অর্ধেক (৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ) মানুষের ওজন বাড়ে। কারণ, দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার কারণে শরীরে এনার্জি ও পুষ্টির চাহিদা বেশি থাকে। ফলে যাঁদের ইফতারে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার থাকে, তাঁদের ওজন বাড়বে। উচ্চ ক্যালরির খাবার বলতে অতিরিক্ত চিনি বা এ–জাতীয় খাবার, কার্বোনেটেড ড্রিংকস, বিরিয়ানি, তেহারি, ফ্রায়েড রাইস, পায়া, নেহারি, কিমা পরোটা, মাংসের চর্বিযুক্ত হালিম, বিভিন্ন ধরনের ফাস্ট ফুড (যেখানে ডাবল চর্বি, মেয়োনেজ, মার্জারিন, বাটার, চিজ মেশানো থাকে), প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, এমনকি অতিরিক্ত তেলে ভাজা ইত্যাদি খাবারের কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের খাবার প্রতিদিন খাওয়া এবং প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া, অন্যদিকে রাতের খাবার খেয়েই শুয়ে পড়া, একইভাবে সাহ্রিতে ক্যালরিবহুল খাবার ও পরিমাণে বেশি খাওয়া, তারপর দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে থাকা, পাশাপাশি রোজায় শারীরিক পরিশ্রম কম করার কারণে শরীরে ক্যালরি জমা হওয়ার হার বৃদ্ধি পেয়ে ওজন না কমে বেড়ে যেতে থাকে।
ওজন কমে যাওয়া
রমজানের শেষ ২ সপ্তাহে সাধারণত রোজাদারদের ওজন কমতে (গড়ে আড়াই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত) থাকে—এ তথ্যও গবেষণা করে পাওয়া। এ সময়ে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের ওজন কমতে থাকে। এটা মূলত রোজার সময়কার ঘুমের ধরন, বিপরীত ধরনের খাওয়ার অভ্যাস ও সময়ের পরিবর্তনে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে গভীর রাতে খাবার খাওয়ায় অনীহা দেখা দেয়। ফলে সাহ্রি না খাওয়ায় শরীরে ক্যালরির ঘাটতি হয়ে ওজন হ্রাস পায়।
যা করতে হবে
তাই শরীরের ওজন যাতে স্বাভাবিক থাকে এবং অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধ করে সুস্থভাবে রোজা রাখা যায়, তার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে:
১. একবারে অতিরিক্ত পরিমাণ না খাওয়া।
২. ক্যালরিবহুল, অস্বাস্থ্যকর, প্রক্রিয়াজাত খাবার যতটা সম্ভব না খাওয়া।
৩. কোনো বেলার খাবার বাদ না দিয়ে (ইফতার, সন্ধ্যারাত ও সাহ্রি) অল্প অল্প করে প্রতিটা পুষ্টি–সংবলিত খাবার প্রতিদিন খাওয়া।
৪. পর্যাপ্ত পানি (আড়াই-তিন লিটার) ও অন্যান্য পানীয় (স্যুপ, ডাল, দুধ, ফল ইত্যাদি) খাওয়া। কারণ, আমাদের শরীরের ফ্লুইডের ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে খাবার, বাকি ৮০ শতাংশ সরাসরি পানি থেকে আসে।
৫. রাতের ঘুম নিশ্চিত করা, যাতে শরীরে কর্টিসল ও স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
৬. প্রতিদিন ব্যায়াম করা। যেমন ২০ রাকাত তারাবিহর নামাজ দাঁড়িয়ে পড়া বা ইফতারের পর কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা, যেকোনো শারীরিক পরিশ্রম করা, যাতে শরীরের ওজন স্বাভাবিক থাকে।
৭. সুষম বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়া। যেমন তাজা শাকসবজি, ফল, মাছ, মুরগি, দুধ, ডিম ও সহজপাচ্য খাবার।
সঠিকভাবে খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম ও ঘুম নিশ্চিত করে, একজন ব্যক্তির পক্ষে শরীরের ওজন স্বাভাবিকে রেখে রোজা রাখা সম্ভব।
ওজন না বাড়াতে
যদি রোজা রেখেও ওজন বাড়তে থাকে বা আপনি আপনার ওজন বাড়তে না দিতে চান, তবে কিছু নিয়ম আপনাকে মেনে চলতে হবে:
১. কম ক্যালরিযুক্ত, কিন্তু সুষম খাবার খেতে হবে। যেমন ইফতারে ঘন চিনির শরবত না খেয়ে ডাবের পানি, ইসবগুলের ভুসি, ফলের (পানি মিশিয়ে) জুস খেতে পারেন।
২. পাশাপাশি কম তেলে ভাজা, চর্বিবিহীন মাংসজাতীয় খাবার ইত্যাদি খেতে পারেন।
৩. ইফতার থেকে সাহ্রি পর্যন্ত একবারে বেশি না খেয়ে বারবার খেতে হবে, যাতে শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তি-পুষ্টি পাওয়া যায়।
৪. খাবারের ক্যালরি কমাতে হবে। আর তার জন্য রান্নায় তেল কম হবে, ডুবোতেলে ভাজা, বাইরের খাবার, মিষ্টিজাতীয় খাবার ইত্যাদি কিছুদিনের জন্য বাদ
দিতে হবে।
৫. সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আপনার যে বাড়তি ওজন আছে, তা ঝরিয়ে ফেলা। সে জন্য প্রতিদিন ইফতারের পর ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা দ্রুত হাঁটবেন। পছন্দমতো ব্যায়াম করবেন প্রতিদিন।
৬. রাতে কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা (যেমন রাত ১০টা থেকে ৩টা) এবং ফজরের পর ১-২ ঘণ্টা ঘুমাবেন।
যদি সম্ভব হয়, একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শমতো রোজার ডায়েট চার্ট তৈরি করে নিতে পারেন।