দেশে ক্যানসারের সব ধরনের চিকিৎসাই সম্ভব

নভেম্বর ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতার মাস। ফুসফুস ক্যানসারসহ নানা ধরনের ক্যানসার বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান এবং সার্ক অনকোলজিস্টস ফেডারেশনের সদ্য সাবেক সম্পাদক ডা. মোস্তফা আজিজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফিয়া আলম

প্রথম আলো:

দেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি আদতে কতটা উদ্বেগজনক?

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রতি এক লাখে ৫৩ জন ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কাছের বা দূরের কোনো না কোনো মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে অন্যান্য ক্যানসারের চেয়ে স্তন ক্যানসার এবং জরায়ুমুখের ক্যানসারের হার বেশি। পুরুষের ক্ষেত্রে ফুসফুস, মুখ, অন্ত্র এবং প্রোস্টেটের ক্যানসার বেশি।

প্রথম আলো :

ক্যানসার এত বাড়ার কারণ কী? ধূমপান না করলেও কি ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে?

ক্যানসার তখনই হয়, যখন কোষের সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। এই অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয় কোষের জিনের বিশেষ পরিবর্তনের কারণে। এই পরিবর্তনের নাম মিউটেশন। বংশগতির বৈশিষ্ট্যের কারণে মিউটেশন হয়, আবার পরিবেশগত প্রভাবেও মিউটেশন হয়। পরিবেশদূষণ এবং ভেজাল খাবারের মতো বিষয়গুলো মিউটেশনের জন্য দায়ী। আর জীবনধারাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্থূলতা এবং কম কায়িক শ্রমের কারণে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। আধুনিক জীবনধারা অনেক ক্ষেত্রেই খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। জীবনকে সহজ করে তুলতে গিয়ে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। সামাজিক পরিসরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ধূমপানের প্রবণতাও ক্যানসারের জন্য দায়ী। তবে ধূমপান ছাড়াও জিনগত এবং পরিবেশগত কারণে ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে। মদ্যপানও বিভিন্ন ক্যানসারের জন্য দায়ী।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ক্যানসারের সব চিকিৎসাই কি বাংলাদেশে সম্ভব?

ক্যানসার চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। আলট্রাসনোগ্রাম, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ম্যামোগ্রাম, এমনকি পেট সিটি স্ক্যানের মতো পরীক্ষা এখন দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই করা সম্ভব। কোনো চাকা বা গোটায় ক্যানসার কোষের উপস্থিতি নির্ণয় করতে এবং কোষের ধরন নির্ণয় করতে সাইটোলজি এবং হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষাও করা হয় বহু প্রতিষ্ঠানে। এসবের বাইরেও ক্যানসারের বৈশিষ্ট্য (ক্যানসার বায়োলজি) নির্ণয় করতে প্রয়োজন হয় ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি এবং মলিকুলার মার্কার টেস্টের মতো পরীক্ষা। দেশে এখন এসব পরীক্ষার সুযোগও রয়েছে। আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের পরীক্ষা হচ্ছে।

ক্যানসারের সব ধরনের চিকিৎসাই বাংলাদেশে সম্ভব। জেনারেল সার্জন ছাড়াও দেশে এখন সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট (বিশেষজ্ঞ ক্যানসার সার্জন) রয়েছেন। কেমোথেরাপির অধিকাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপির মতো আধুনিক চিকিৎসাও হচ্ছে দেশে।

তবে রেডিওথেরাপির সুযোগ কিছুটা অপ্রতুল। দেশের করপোরেট হাসপাতালগুলোয় বিশ্বমানের রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এ দেশের বহু মানুষেরই সেই সেবা গ্রহণ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাই ভরসা সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় যতগুলো রেডিওথেরাপি মেশিন আছে, তা দিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই একজন রোগীর সিরিয়াল পেতে ৬-৮ মাস লেগে যায়। সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে ষোলটি রেডিওথেরাপি মেশিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি মূলত কী ধরনের চিকিৎসা?

সহজভাবে বলা যায়, ক্যানসার কোষের কোনো নির্দিষ্ট অংশকে লক্ষ্যবস্তু করে যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, তা টার্গেটেড থেরাপি। তবে সব ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্দিষ্ট টার্গেট পাওয়া যায় না। যাঁদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, তাঁদের জন্য চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায়। টার্গেটেড থেরাপি দেহের সব কোষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। বাসায় থেকেই এই চিকিৎসা চালানো যায়। আর এদেশে টার্গেটেড থেরাপির খরচ অবিশ্বাস্য রকম কম। একই ওষুধ দেশের বাইরে থেকে আনতে হলে প্রায় এক শ গুণ বেশি খরচ পড়ে।

ইমিউনোথেরাপি এ যুগে ক্যানসার চিকিৎসার গেম চেঞ্জার। এ চিকিৎসাপদ্ধতিতে রোগীর নিজস্ব রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হয়। এমনও হয়েছে, যে রোগীর আয়ু সাত মাসের কাছাকাছি ধরে নেওয়া হয়েছে, ইমিউনোথেরাপিতে তিনি সাত বছর অবধি দিব্যি বেঁচে আছেন।

নভেম্বর মাস ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতা মাস
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

প্রথম আলো :

কেমোথেরাপির যেসব ওষুধ দেশে তৈরি হচ্ছে, এগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে জানতে চাই।

দেশে তৈরি হওয়া কেমোথেরাপির ওষুধ গ্রহণ করে বহু রোগী সুস্থ হয়েছেন। আবার আমরা এমনও অনেক রোগী দেখেছি, দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর পরেও যাঁদের ক্যানসার ফিরে এসেছে। ক্যানসার এমন এক রোগ, যা আপনি শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে চিকিৎসা করাতে পারবেন না। চিকিৎসক হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশে তৈরি করা এসব ওষুধ ক্যানসারের চিকিৎসায় কার্যকর। অনেক ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের জন্য অনেকটা বেশি হলেও দেশের বাইরের চেয়ে তা অন্তত কয়েক গুণ কম।

প্রথম আলো :

প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার শনাক্ত করা কেন এত জরুরি?

প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়লে ক্যানসার নির্মূল করা অনেক সহজ হয়। খরচও কম হয়। তাই ছোটখাটো উপসর্গকে অবহেলা করতে নেই। তবে অনেক ক্যানসারেই প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তাই স্ক্রিনিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্ক্রিনিং এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ একজন মানুষের দেহে ক্যানসারের উপস্থিতি শনাক্ত করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট বয়সে এসে নিয়মিত এসব স্ক্রিনিং (পরীক্ষা) করানো হলে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন