আপনি শুচিবাই না তো?

শুচিবাইগ্রস্ততা একটি মানসিক রোগ

প্রতিদিন কলেজে যেতে দেরি করে রুদ্র (ছদ্মনাম)। সকালে বাথরুমে ঢুকলে আর বের হতে চায় না। এ নিয়ে বাড়ির সবাই বিরক্ত। কিন্তু রুদ্র বাথরুম থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হতে চায়, ততই দেরি হয়। পরিষ্কার হওয়ার জন্য সে যতবার পানি ব্যবহার করে, ততবার মনে হয় ময়লা লেগে আছে। বারবার হাত ধোয়, সাবান দেয়, তবু মনে তৃপ্তি আসে না।

এদিকে কিছুদিন থেকে আনিকা (ছদ্মনাম) খুব চুপচাপ। কারও সঙ্গে কথা বলে না, প্রশ্ন করলে দু–এক শব্দে উত্তর দেয় মাত্র। খাওয়াদাওয়া কমে গেছে, অনেক সকালে ঘুম ভেঙে যায়। বিড়বিড় করে তওবা করে, সৃষ্টিকর্তার কাছে মাফ চায়। কিন্তু কেন, তা কাউকে বলে না। পরে শোনা গেল, তার মনে অনেক আজেবাজে চিন্তা আসে, নিজেকে মনে হয় পাপী।

ওপরের দুটি ঘটনাই শুচিবাইগ্রস্ততা। ওসিডি (অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার) বা শুচিবাইগ্রস্ততা একটি মানসিক রোগ। যেকোনো বয়সে রোগটি হতে পারে। তবে বয়ঃসন্ধিকালে বা ২৫ বছরের আগে তরুণ-তরুণীদের এই রোগ বেশি হয়। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।

শুচিবাই বা ওসিডি কী

ওসিডি বা শুচিবাইগ্রস্ততা বুঝতে হলে আমাদের ‘অবসেশন’ ও ‘কমপালশন’ শব্দ দুটি বুঝতে হবে। অবসেশন হলো দীর্ঘদিন ধরে বারবার অস্বাভাবিক বা অগ্রহণীয় চিন্তা, প্রতিচ্ছবি বা তাড়না, যা রোগীর মনে বারবার আসে এবং চাইলেও সেই চিন্তা, প্রতিচ্ছবি বা তাড়না দূর করা যায় না। কমপালশন হলো বারবার একই ধরনের আচরণ বা কাজ, যা অবসেশনের কারণে রোগী করে থাকে।

ওসিডি রোগীর অবসেশন বা কমপালশন বা দুটিই থাকতে পারে। ওসিডি রোগীর রোগ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি থাকে, তাই বারবার একই চিন্তা বা তাড়না বা একই অস্বাভাবিক আচরণ করছে, তা সে বুঝতে পারে কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

ওসিডির অবসেশন ও কমপালশন অনেক ধরনের হয়ে থাকে। ক্লিনিং বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবসেশন হয় সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া পরীক্ষণ (চেকিং), সন্দেহবাতিকতা, প্রতিসাম্য (সিমেট্রি), গণনা, ধর্মীয়, যৌন–সম্পর্কিত, ক্ষতি করার প্রবণতা, অবসেসিভ ফোবিয়া অবসেশনও হয়ে থাকে। একই রোগীর একসঙ্গে কয়েকটি অবসেশন থাকতে পারে।

ওসিডি রোগীর অন্যান্য রোগ

ওসিডি হওয়ার পেছনে জন্মগত, জিনগত, মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের (সেরোটোনিন) ভারসাম্যহীনতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, অবস্থাগত শেখা আচরণসহ নানা কারণ দায়ী।

ওসিডি রোগের সঙ্গে অন্যান্য মানসিক রোগ থাকে। যেমন বিষণ্নতা, সামাজিক ভয়, মাদকাসক্তি (অ্যালকোহলিজম), মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ফোবিয়া, প্যানিক ডিজঅর্ডার, খাদ্যাভ্যাসের সমস্যা (ইটিং ডিজঅর্ডার), ব্যক্তিত্বের সমস্যা (অবসেসিভ কমপালসিভ পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার), মুদ্রাদোষ বা টিকস, টুরেটস সিনড্রোম ইত্যাদি।

রোগ নির্ণয়

ওসিডি আক্রান্ত রোগীর মনে একই চিন্তা বারবার আসতে থাকে, যা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে থেকে থামাতে বা দূর করতে পারে না। রোগীর মধ্যে অস্থিরতা, অশান্তি তৈরি করে; এই অশান্তি দূর করার জন্য রোগী বারবার হাত ধোয় বা ঘরের তালা চেক করে বা মুখে বিড়বিড় করে, যা তাকে সাময়িক শান্তি বা স্বস্তি দেয় এবং কিছুক্ষণ পর একই চিন্তা আবার আসতে থাকে। এভাবে একটি চক্রের মতো একই কাজ বারবার করতে থাকে। রোগী যা নিজে বুঝেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

রোগের গতিপথ

প্রায় অর্ধেকের বেশি রোগীর ওসিডি হঠাৎ শুরু হয়। ৫০ থেকে ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনো মানসিক চাপ, যেমন গর্ভাবস্থা, যৌন সমস্যা বা কাছের কেউ মারা গেলে উপসর্গ শুরু হয়। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে রোগটি লুকিয়ে রাখেন এবং অনেক বছর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। রোগটি একেকজন রোগীর ক্ষেত্রে একেক ধরনের গতিধারায় দেখা যায়। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি ও পরিবর্তনশীল রোগ। কখনো কখনো কমবেশি, কখনো ভালো, কখনো খারাপ আবার কারও ক্ষেত্রে রোগটি স্থিতিশীল।

রোগের পরিণতি

প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ওসিডি রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগী মধ্যম পর্যায়ে উন্নতি হয় এবং কমবেশি স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রোগী খারাপ থাকে এবং পর্যায়ক্রমে আরও খারাপ হয়। কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছর চিকিৎসার পর ৫০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। ওসিডি রোগীর এক-তৃতীয়াংশ গুরুতর বিষণ্নতায় ভোগে। বিষণ্নতায় ভোগা এই রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে।

ওসিডি রোগীর চিকিৎসা

ওসিডি একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। এই রোগের চিকিৎসায় সাইকোথেরাপি যেমন আছে, তেমনি অনুমোদিত বেশ কিছু ওষুধও আছে। তবে দুই ধরনের মিলিত চিকিৎসার ফলাফল একক চিকিৎসার চেয়ে কার্যকরী।

লজ্জা বা দ্বিধা নয়, বরং ওসিডি হলে সময়মতো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা নিন, সুস্থ থাকুন।

ডা. মো. রশিদুল হক: সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ।