বিশ্ব ক্যানসার দিবস: স্বকীয়তায় ঐক্যবদ্ধ
বিশ্ব ক্যানসার দিবস একটি আন্তর্জাতিক দিবস, যা প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং এটি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। ইউআইসিসির ২০২৫-২৭ সালের প্রতিপাদ্য, ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’, যেখানে প্রত্যেক ক্যানসার রোগীর অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এটি ক্যানসার রোগীদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি এবং তাঁদের লড়াইয়ের প্রতি সম্মান জানায়।
ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গতি এনে, সবাই একত্র হয়ে একটি পৃথিবী কল্পনা করছি, যেখানে লাখ লাখ ক্যানসার রোগীর মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর জীবনরক্ষাকারী ক্যানসার চিকিৎসা ও যত্নের প্রবেশাধিকার সবার জন্য সমান হবে, তা আপনি কে ও কোথায় বাস করেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এ ছাড়া মানুষকে সেবার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে এবং পরিবর্তন আনার নতুন উপায়গুলো অন্বেষণ করে। ক্যানসার শুধু একটি চিকিৎসাগত নির্ণয় নয়, এটি একটি গভীরভাবে ব্যক্তিগত বিষয়। প্রতিটি নির্ণয়ের পেছনে রয়েছে একটি অনন্য মানবিক গল্প—দুঃখ, যন্ত্রণা, আরোগ্য, স্থিতিস্থাপকতা, ভালোবাসা এবং আরও অনেক কিছুর গল্প। এ কারণে ক্যানসার রোগীর যত্নে একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রত্যেক ব্যক্তির অনন্য প্রয়োজনকে সহানুভূতি এবং সহানুভূতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একীভূত করে। এই বিশ্ব
ক্যানসার দিবসে চলুন, আমরা একত্র হয়ে ক্যানসার রোগীর যত্নের ভবিষ্যৎটি নতুন করে লিখি, যেখানে মানুষের ও সম্প্রদায়গুলোর প্রয়োজন আগে থাকবে।
বাংলাদেশে ক্যানসারের বোঝা বাড়ছে, প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হয় ও দেরিতে রোগনির্ণয়ের এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসাসুবিধার কারণে উচ্চ মৃত্যুহার রয়েছে। জনসংখ্যার মধ্যে প্রধান ক্যানসারের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুসফুস, স্তন, জরায়ুমুখ, গলা-মুখগহ্বর, খাদ্যনালি ও কোলোরেক্টাল ক্যানসার। ক্যানসারের বোঝা বাড়ানোর পেছনে জীবনযাত্রার অভ্যাস, তামাক সেবন, পরিবেশগত দূষণ, বায়ুদূষণ, ক্ষতিকর এজবেসটস ব্যবহার, ভেজাল খাদ্য, ফসলে ও শাকসবজিতে ক্ষতিকর
ভারী ধাতুর উপস্থিতি, মাংস ও মাছে ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি এবং স্বাস্থ্যসেবার
সীমিত প্রবেশাধিকার উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে কাজ করছে।
ক্যানসার ব্যবস্থাপনার প্রধান সমস্যা
নির্ণয়সুবিধার সীমিত প্রবেশাধিকার—স্ক্রিনিং ও উন্নত ডায়াগনস্টিক সুবিধার অভাব।
ওষুধের উচ্চমূল্য—যদিও বাংলাদেশে ক্যনসারের অধিকাংশ ওষুধই তৈরি হয়, কিন্তু উচ্চমূল্যের কারণে বেশির ভাগ রোগী প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় করতে পারেন না।
চিকিৎসা উপকরণের অভাব—ক্যানসার চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন লিনিয়ার এক্সিলেটর (প্রয়োজন ১৮০টি, আছে ২১টি) ও ব্রাকিথেরাপির (প্রয়োজন ১৫০টি, আছে ২০টি) অপ্রতুলতা।
বিশেষজ্ঞ স্বল্পতা—ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি।
অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা—ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তার অভাব।
সচেতনতার অভাব—অধিকাংশ রোগীর দেরিতে রোগনির্ণয় হয়, ফলে চিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
গবেষণার অভাব—স্থানীয় রোগীদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণার সীমিত সুযোগ।
২০৪০ সালের মধ্যে ক্যানসার ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের পদক্ষেপ
প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও রোগনির্ণয়: আধুনিক প্রযুক্তি ও কমিউনিটিভিত্তিক স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করে ক্যানসার দ্রুত শনাক্ত করা।
দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন: ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, নার্স ও প্যারামেডিকসদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
অর্থনৈতিক সহায়তা ও স্বাস্থ্যবিমা: ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় কমাতে স্বাস্থ্যবিমা ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা চালু করা।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ক্যানসারের প্রতিরোধ, প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে স্কুল ও কমিউনিটিতে।
গবেষণা ও উদ্ভাবন: স্থানীয় রোগীদের
জন্য নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি ও প্রতিরোধব্যবস্থা
নিয়ে গবেষণা করা এবং উদ্ভাবনী গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন: ক্যানসার চিকিৎসাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়ে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা।
বিশেষ উদ্যোগ
বিশেষায়িত ক্যানসার সেন্টার: বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ক্যানসার সেবা চালুসহ বিএসএমএমইউর অধীন একটি আধুনিক ক্যানসার ইনস্টিটিউট চালু করা, যাতে রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে না হয়। এ ছাড়া শীর্ষস্থানীয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আধুনিক ক্যানসার সেবা প্রদান করা।
আধুনিক ডায়াগনস্টিক সুবিধার সম্প্রসারণ: উন্নত ডায়াগনস্টিক ল্যাব, হিস্টোপ্যাথলজি ল্যাব ও স্ক্রিনিং সেন্টার স্থাপন।
সর্বজনীন ক্যানসার চিকিৎসা: ক্যানসার বিমা ও সহায়তা স্কিম চালু করে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসুবিধা প্রদান।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন: চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: উন্নত ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসাপদ্ধতির জন্য আন্তর্জাতিক ক্যানসার সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারত্ব।
টেলিমেডিসিন ও অনলাইন চিকিৎসা: প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান।
আন্তর্জাতিক মানের আঞ্চলিক ক্যানসার কেন্দ্র: ৮টি আঞ্চলিক ক্যানসার সেন্টার স্থাপন।
সরকারি-বেসরকারি সহায়তার মাধ্যমে নতুন নতুন ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্যোক্তাদের ১০ বছরের জন্য কর রেয়াত প্রদান করা।
ক্যানসারের সেবা ও সব ওষুধের ওপর কর মওকুফ এবং সর্বোচ্চ খুচরামূল্য ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা।
একটি ক্যানসার ফান্ড তৈরি করা, যার অর্থ আসবে ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ তামাক, অ্যালকোহল, প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্র, এসবেসটস, কোমল পানীয়, বিভিন্ন ক্ষতিকর বর্জ্য উৎপাদনকারী কারখানা, এদের ওপর আরোপ করা ট্যাক্স (সিনট্যাক্স) থেকে।
‘আসুন, সুস্থ জীবন ও ক্যানসারমুক্ত আগামীর জন্য একসঙ্গে পথ চলি।’
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, স্কয়ার ক্যানসার সেন্টার
এবং সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন