হৃদরোগে আক্রান্তরা ব্যায়াম করবেন, নাকি করবেন না?

পরিণত বয়সী জনগোষ্ঠীর প্রায় ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষ হৃৎপিণ্ডের বৈকল্য সমস্যায় ভোগেন। সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এই হার ১০ শতাংশের বেশি। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যাঁরা শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন, তাঁদের ছয়জনের একজন হার্ট ফেইলিওরের রোগী।

কেমন হবে হৃদরোগে আক্রান্তদের জীবনাচরণ

১. হার্ট ফেইলিওর রোগীদের স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণ জরুরি। ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই ডায়াবেটিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

২. ধূমপান, মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে ছাড়তে হবে। অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেশি।

৩. হার্ট ফেইলিওরের রোগীকে পানি মেপে খেতে হয়, তাতে হৃৎপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমে। যারা ক্রনিক হার্ট ফেইলিওরে ভুগছেন, তাঁদের দৈনিক দেড় থেকে দুই লিটারের বেশি পানি খাওয়া উচিত নয়।

৪. খাবারে বাড়তি লবণ বাদ দিতে হবে। অতিরিক্ত লবণসমৃদ্ধ খাবার, যেমন প্রক্রিয়াজাত মাংস, আচার, পনির, সস, সয়া সস, লবণ মাখানো চানাচুর বা বাদাম ইত্যাদিও কম খেতে হবে।

৫. প্রতিদিন যতটা সম্ভব ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কে কতটুকু ব্যায়াম করতে পারবেন, তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।

৬. একদমই ব্যায়ামে অভ্যস্ত না হলে শুরুতে কয়েক মিনিটের হাঁটাহাঁটির চর্চা করতে হবে। এই হাঁটাহাঁটি প্রতিদিন পাঁচ-সাত মিনিট করে বাড়াতে হবে। এভাবে মাসখানেকের মধ্যে প্রতিদিন কমপক্ষে আধা ঘণ্টা হাঁটায় অভ্যস্ত হতে হবে।

৭.রক্তনালিতে রিং লাগানো হলে বা বাইপাস অপারেশন হয়ে থাকলেও একই নিয়মে ব্যায়াম করতে হবে বা হাঁটতে হবে।

শীতে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। মডেল: কাওসার
ছবি: প্রথম আলো

ব্যায়াম করবেন নাকি করবেন না?

কী কারণে হার্ট ফেইলিওর হয়েছে, ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি কারণটি হয় হৃৎপিণ্ডের ভালভের অসুখ, জন্মগত হৃদ্‌রোগ বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের সমস্যা, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশি ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম করা যাবে না।

ব্যায়ামকালীন অজ্ঞান হওয়ার ইতিহাস থাকলে ব্যায়াম করা যাবে না। রোগী ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করবেন ততটুকু, যতটুকুতে কোনো শ্বাসকষ্ট না হয়, বুকে চাপ বা ব্যথা না হয় অথবা বুক ধড়ফড় অনুভূত না হয়। মনোবল হারানো যাবে না। হৃৎপিণ্ডের রোগে সুস্থ থাকার জন্য মনের সাহস ও আত্মবিশ্বাস খুব দরকার। নিজেকে চাপমুক্ত রাখতে হবে।

নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ

হার্ট ফেইলিওরের রোগীর নিয়মিত ফলোআপ গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক যেভাবে পরামর্শ দেবেন, সেভাবে চেকআপ ও ওষুধপত্র ঠিক করে নিতে হবে। ফলোআপ যতটা সম্ভব রোগী যেখানে অবস্থান করেন, তার নিকটবর্তী স্থানে হলে ভালো। ফলোআপের জন্য সব সময় যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বা বিশেষায়িত হাসপাতালে যেতে হবে, এমন নয়। বরং নিকটবর্তী স্থানীয় চিকিৎসক ও স্থানীয় হাসপাতালেই ফলোআপের জন্য যেতে পারেন। তবে যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে রোগীকে বিশেষায়িত হাসপাতালে নিতে হবে। কিছু বিশেষায়িত হাসপাতালে এখন আলাদা করে হার্ট ফেইলিওরের ক্লিনিক চালু আছে।

হার্ট ফেইলিওর চিকিৎসার ফলাফল নির্ভর করে হার্ট ফেইলিওরের কারণের ওপর। কারণ নির্ণয় করে নির্দিষ্ট চিকিৎসায় তা সম্পূর্ণ দূর করতে পারলে খুব ভালো। তবে হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিওমায়োপ্যাথির ক্ষেত্রে চিকিৎসা আজীবন চালানো লাগে। আবার স্ট্রেস কার্ডিওমায়োপ্যাথি ও গর্ভকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথিতে হার্ট ফেইলিওর হলে সাধারণত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে এ দুই ধরনের হার্ট ফেইলিওর খুব কম দেখা যায়।

হার্ট ফেইলিওরের শেষ চিকিৎসা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন। সব ধরনের যোগ্যতা মিলিয়ে হৃৎপিণ্ডদাতা পাওয়া খুব দুরূহ। আমাদের দেশে এখনো হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন শুরু হয়নি।

কিছু পরামর্শ

হার্ট ফেইলিওরের রোগীর নিয়মিত ওষুধ সেবন জরুরি। কোনো ওষুধের পরিবর্তন বা ডোজ কমানো-বাড়ানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

হৃদ্‌রোগ ছাড়া অন্য কোনো অসুখের জন্য অন্য কোনো ওষুধের দরকার পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ ও স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ হার্ট ফেইলিওরের উপসর্গের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

রক্তশূন্যতা হলে হার্ট ফেইলিওর বেড়ে যায়। তাই কোনোভাবে রক্তশূন্যতা হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখতে হবে। রক্তশূন্যতা থাকলে চিকিৎসা নিতে হবে।

থাইরয়েডের সমস্যা হার্ট ফেইলিওরের জন্য বিপজ্জনক। যাঁদের থাইরয়েডের অসুখ আছে, তাঁদের চিকিৎসায় অবহেলা করা যাবে না।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীরা অল্পতেই জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হন। আর যেকোনো জীবাণু সংক্রমণে হার্ট ফেইলিওর বাড়তে পারে।

হার্ট ফেইলিওরের রোগীদের হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হৃদ্‌রোগ বিভাগ, জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা