স্টিভেন জনসন সিনড্রোম—যে অসুখ হয় ওষুধের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়
স্টিভেন জনসন সিনড্রোম এক গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার নাম। সাধারণত কোনো ওষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। এটি একটি বিরল অসুখ, যা ১০ লাখে ৫ জনের হতে পারে।
কী হয়
স্টিভেন জনসন সিনড্রোম একধরনের হাইপারসেনসিটিভিটি রিঅ্যাকশন, সাধারণভাবে যাকে বলা যায় অতিসংবেদনশীলতা। ওষুধ ছাড়া কিছু সংক্রমণের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। এখানে ত্বকের বাইরের দুটি স্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ছাড়া মুখগহ্বর, চোখ, অন্ত্র, শ্বাসনালিতে ক্ষত তৈরি হয়। ত্বকের আবরণ নষ্ট হওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে এবং পানিশূন্যতা তৈরি হয়। ফলে সেপসিসের মতো প্রাণঘাতী অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেপসিস এমন এক অবস্থা, যেখানে সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
যেসব ওষুধে ঝুঁকি বেশি
যেকোনো ওষুধেই স্টিভেন জনসন সিনড্রোম হতে পারে। তবে কাদের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া হবে, তা আগে থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সাধারণত যেসব ওষুধে বেশি হয়—
• গাউট বা গেঁটেবাতের ওষুধ: অ্যালোপিউরিনল
• খিঁচুনির ওষুধ: কার্বামাজেপিন, ফিনাইটোইন, ফেনোবারবিটাল, ল্যামোট্রিজিন
• কিছু অ্যান্টিবায়োটিক: কোট্রাইমক্সাজল ইত্যাদি
• রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ওষুধ: সালফাসালাজিন
• ব্যথানাশক: মেলোক্সিকাম ও পাইরোক্সিকাম
লক্ষণগুলো কী
লক্ষণগুলো সাধারণত ওষুধ সেবনের প্রথম আট সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় এবং ফ্লু-জাতীয় উপসর্গ দিয়ে শুরু হয়।
প্রাথমিক উপসর্গ: তীব্র জ্বর, গায়ে ব্যথা, ক্লান্তি বা ফ্লু-জাতীয় সাধারণ অসুস্থতার লক্ষণ।
এরপর দেখা দিতে থাকে যেসব লক্ষণ—
ত্বক লাল হয়ে যাওয়া।
ফোসকা পড়া।
মৃত কোষ স্তরের মতো খসে পড়া।
মুখের ভেতরে ও ঠোঁটে গুরুতর যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত (আলসার), যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি কিছু খেতে পারেন না।
যৌনাঙ্গে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখে পানি পড়া এবং চোখ জ্বালা করা।
শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে পানি জমা বা নিউমোনিয়ার মতো ইনফেকশন হওয়া।
চিকিত্সা ও ব্যবস্থাপনা
স্টিভেন জনসন সিনড্রোম একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি এবং দ্রুত হাসপাতালে চিকিত্সা শুরু করা অপরিহার্য।
ওষুধ বন্ধ করা: সবার আগে সন্দেহজনক বা কারণ হিসেবে চিহ্নিত ওষুধটি তত্ক্ষণাৎ বন্ধ করতে হবে।
হাসপাতালে ভর্তি: রোগীকে সাধারণত আইসিইউ অথবা বার্ন ইউনিটে (পোড়া রোগীর মতো বিশেষ যত্নের জন্য) ভর্তি রেখে চিকিত্সা দেওয়া হয়।
সাপোর্টিভ কেয়ার: সুস্থ হতে সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ লাগতে পারে। এই সময়ে যা প্রয়োজন হতে পারে—মৃত কোষ সরানো, নিয়মিত ড্রেসিং ও ত্বক পরিষ্কার রাখা।
তীব্র ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া।
সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার।
শিরাপথে স্যালাইন দিয়ে পানিশূন্যতা এবং ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স (লবণের তারতম্য) নিয়ন্ত্রণ করা।
পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করা। গুরুতর মুখের ক্ষতের জন্য কখনো কখনো ফিডিং টিউবের প্রয়োজন হতে পারে।
ত্বকের ক্ষতি খুব গুরুতর হলে ত্বক প্রতিস্থাপন (স্কিন গ্রাফটিং) দরকার হতে পারে।
সতর্কতা ও করণীয়
স্টিভেন জনসন সিনড্রোম থেকে সুস্থ হওয়ার পর ভবিষ্যতে জটিলতা এড়াতে কিছু বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সে জন্য যা করতে পারেন—
ওষুধ পরিহার: যে ওষুধে সমস্যা হয়েছিল, তা আর কখনো সেবন করা যাবে না। ভবিষ্যতে যেন ভুলবশত সেই ওষুধ না দেওয়া হয়, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
মেডিকেল অ্যালার্ট: একটি মেডিকেল অ্যালার্ট ব্রেসলেট বা কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। যাতে নির্দিষ্ট ওষুধটির নাম উল্লেখ থাকে।
চিকিত্সকের সঙ্গে যোগাযোগ: পরবর্তী সময়ে যেকোনো কারণে অন্য চিকিত্সকের কাছে গেলে অবশ্যই শুরুতে আপনার স্টিভেন জনসন সিনড্রোমের ইতিহাস এবং কারণ হিসেবে চিহ্নিত ওষুধের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে হবে।
নিজে নিজে চিকিত্সা নয়: চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে কোনো ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।