মাইগ্রেন: শুধুই কি মাথাব্যথা

প্রথম আলোর স্বাস্থ্যবিষয়ক নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি (৬ সেপ্টেম্বর) মাইগ্রেন সমস্যার নানা দিক নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান ‘মাথা নিয়ে মাথাব্যথা’র প্রথম পর্ব। ‘মাইগ্রেন মাথাব্যথা সচেতনতা সপ্তাহ ২০২২’ উপলক্ষে জরুরি এ বিষয় নিয়ে আলোচনার সময়োপযোগী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সার্বিক সহযোগিতা করেছে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এসকেএফের মাইগ্রেনসহ অন্যান্য মাথাব্যথানাশক ওষুধ টাফনিল, ডিটান জেনেরিক উপাদানযুক্ত প্রথম মাইগ্রেন চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ লাসমি এবং মাইগ্রেনের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে কার্যকর ওষুধ নোরিয়াম।

আলোচনার সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন সুস্মিতা শ্রুতি চৌধুরী। আলোচক হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী এবংতরুণ সংগীতশিল্পী অবন্তী সিঁথি।

মাইগ্রেন সমস্যার নানা দিক নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান ‘মাথা নিয়ে মাথাব্যথা’র প্রথম পর্ব
ছবি: সংগৃহীত

মাইগ্রেন এক বিশ্বজনীন সমস্যা। তবে মাইগ্রেন মানে কি শুধুই মাথাব্যথা?—প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী জানান, গ্রিক শব্দ এমিক্রেনিয়া থেকেই এই নামটির উৎপত্তি, যার অর্থ হচ্ছে আধকপালে মাথাব্যথা। সাধারণত বেশির ভাগ মাইগ্রেন রোগীর মাথাব্যথা একদিক থেকে শুরু হয়ে পুরো মাথায় ছড়ায়। তিনি বলেন, মাইগ্রেন বহু পুরোনো একটি সমস্যা। সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগে থাকে। মাইগ্রেন বলতে সাধারণত মাথাব্যথাকে বোঝানো হলেও এর রয়েছে আরও বেশ কিছু লক্ষণ। মাইগ্রেনের রোগীরা মাথাব্যথার সঙ্গে মাথা ঘোরানো, চোখে ঝাপসা দেখা, বমি বা বমিভাব আর আলো ও শব্দের প্রতি অতিসংবেদনশীলতাজনিত লক্ষণের কথা বলে থাকেন। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অ্যাবডমিনাল মাইগ্রেন অর্থাৎ পেটব্যথা, বমি ও মাথা ঘোরানোর অভিযোগ করে, যা মা–বাবারা প্রায়ই স্কুল বা পড়াশোনার ব্যাপারে ভীতি ভেবে ভুল করেন। আবার কিছু বিশেষ ধরনের মাইগ্রেন আছে। কোনো কোনো মাইগ্রেন রোগী শুধু মাথা ঘোরানোর ব্যাপারে অভিযোগ করেন ডাক্তারের কাছে। একে বলে ‘ভেস্টিবুলার মাইগ্রেন’।

‘হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেনে’র ক্ষেত্রে শরীরের এক দিক অবশ হয়ে আসতে পারে। আবার মাইগ্রেনের জন্য চোখে কম দেখলে তাকে ‘রেটিনাল মাইগ্রেন’ বলা হয়। তবে সাধারণ অর্থে মাইগ্রেনের প্রধান লক্ষণই হলো মাথাব্যথা।

কোন বয়সের মানুষ মাইগ্রেনে বেশি আক্রান্ত হয়? জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী বলেন, ‘সাধারণত ১০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে মাইগ্রেন হওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই মাইগ্রেনে ভোগেন বেশি। এর মাঝে পুরুষ রোগীর চেয়ে নারী রোগীর সংখ্যা বেশি।’

সামনেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ সময় বহু পরীক্ষার্থী মাথাব্যথায় ভুগছে। তাদের কষ্ট লাঘবে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী বেশ কিছু সুচিন্তিত সমাধান দেন। তিনি বলেন, পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা মাথাব্যথায় ভোগে। আর বেশির ভাগ সময় রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখা যায়, তা স্ট্রেসজনিত টেনশন–টাইপ মাথাব্যথা। কিন্তু যাদের আগে থেকেই মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে, তারা পরীক্ষার আগে এমন সময়ে বেশি ভুগে থাকে। পড়ার চাপ, পরীক্ষাসংক্রান্ত ভীতি বা দুশ্চিন্তা তো আছেই, সঠিক সময়ে ও ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করা, ঘুমের অনিয়ম বা যথেষ্ট বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণও এখানে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এ জন্য তিনি পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্রাম নিতে বলেন। পরামর্শ দেন বিনোদনমূলক কিছু করারও। তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন শুধু ওষুধ নয়, অবন্তী সিঁথির মতো সংগীতশিল্পীদের গানও মাথাব্যথা উপশমে অনেক সহায়ক। রিল্যাক্স করা, রাত না–জাগা, নিজেকে পরীক্ষা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ না দেওয়ার ব্যাপারেও গুরুত্ব দেন তিনি।

অবন্তী সিঁথি কীভাবে তাঁর ব্যস্ত জীবনযাপনের রুটিনে মাথাব্যথার সমস্যা মোকাবিলা করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই গানে হাতেখড়ি তাঁর। বিভিন্ন ফেলনা বা আটপৌরে জিনিসের সমন্বয়ে পারকাশনসহকারে সংগীত পরিবেশন করতে ভালোবাসেন তিনি। কাজের চাপ থাকলেও তিনি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করেন। সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নেন ব্যস্ত শিডিউল থেকে সময় বের করে। ঘুম ভালো হলেই তাঁর মাথাব্যথা বেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে জানান সিঁথি।

আলোচনার এ পর্যায়ে দর্শকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী মাইগ্রেন–সংক্রান্ত নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন। মাইগ্রেন কি কখনো পুরোপুরি ভালো হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ৪৫ বছর বয়সের পর থেকে মাইগ্রেন আস্তে আস্তে কমে আসে। সঠিক মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলে সত্যিকার অর্থেই মাইগ্রেন নিরাময় করা সম্ভব। আরেকজন দর্শক সরাসরি মাইগ্রেনের ব্যথার ওষুধ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাইগ্রেন চিকিৎসার আসলে দুটি পর্যায় রয়েছে। নন–ফার্মাকোলজিক্যাল পদ্ধতি অর্থাৎ ওষুধ ছাড়া জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে বেশ সুফল পেতে পারেন মাইগ্রেন রোগীরা। রোগীর নিজেকেই বুঝতে হবে তার ঠিক কী কী কারণে মাথাব্যথা হয়। কারও হয়তো লম্বা ভ্রমণ, দীর্ঘক্ষণ ধরে অনাহার বা তীব্র শব্দে মাথাব্যথা করতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ‘মাইগ্রেন ট্রিগার’। পারলে এই ট্রিগারগুলো এড়িয়ে চললে মাইগ্রেন অ্যাটাক কম হবে। আর ওষুধের মাধ্যমে মেডিকেল ম্যানেজমেন্টেও মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের ড্রাগস ব্যবহার করা হয়। এর একটি ভাগ হচ্ছে ব্যথানাশক বা উপশমকারী। এগুলো মাইগ্রেন প্রতিরোধ করে না। অ্যাবরটিভ থেরাপি ধাঁচের এ পেইনকিলার ওষুধগুলো বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাধারণ প্যারাসিটামল ছাড়াও টলফেন্যামিক অ্যাসিড জেনেরিক গ্রুপের টাফনিলজাতীয় ওষুধ বেশ কাজে দেয়। এ ছাড়া রয়েছে আইবুপ্রোফেন, নেপ্রক্সেনসহ নতুন আসা লাসমিডিটান গ্রুপের ও ট্রিপ্টান ধরনের ওষুধসমূহ। এ ছাড়া মাইগ্রেন প্রতিরোধ করতে চিকিৎসক প্রয়োজনবোধ করলে রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ দিয়ে থাকেন, যা বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে দেওয়া হয় এবং কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা যাবে না। কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছরও খেতে হতে পারে এ ওষুধগুলো।

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে অবন্তী সিঁথি গিটার–সহযোগে গান শোনান। আর ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী আগেই বলেছেন সংগীত রিল্যাক্সড মুড ও বিনোদন দিতে পারে, যা মাইগ্রেনসহ সব ধরনের মাথাব্যথা উপশমে সহায়ক। এ পর্যায়ে একজন দর্শক জানালেন, দিনে লম্বা সময় হিজাব পরে থাকায় তাঁর খুব মাথাব্যথা হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী বলেন, মাইগ্রেন ট্রিগার করে এমন কিছু এড়িয়ে চলতে পারলেই ভালো এবং তা রোগীকেই বুঝতে হবে যে কী তাঁকে ট্রিগার করছে। অবন্তী সিঁথি প্রসঙ্গক্রমে জানালেন, কাজের চাপে মাথাব্যথা হলে তিনি কোলাহলমুক্ত কোথাও গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এতেই উপকার পান।

এক ভুক্তভোগী দর্শক জানতে চান, মাইগ্রেন যাতে না হয়, সে জন্য কী করা যায়। বংশগত বা শারীরবৃত্তীয় কারণ ঠেকানো না গেলেও পরিবেশগত কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে মতামত দেন ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী। তিনি বলেন, ‘এ অস্থির সময়ে আমরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিই না। বিশ্রাম নেওয়ার সময়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা অন্যভাবে স্ক্রিনে সময় দিই। ফলে আমাদের চোখ ও মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায় না। এই ব্যাপার এখন মাইগ্রেনের এক বড় কারণ। তাই তিনি পরামর্শ হিসেবে বলেন, তরুণ প্রজন্মের যারা মাইগ্রেন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদেরকে সচেতন হতে হবে। বিশ্রাম নিতে হবে। শুধু কাজ বা পড়াশোনা নিয়ে থাকলে চলবে না। খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক বা সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত হতে হবে। পুষ্টিকর খাবার যেমন ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনযুক্ত খাবার নিয়মিত খেলে মাইগ্রেন প্রতিরোধ করা যায়। যদি মাইগ্রেন শনাক্ত হওয়ার পর কারও সপ্তাহে একাধিকবার তীব্র মাথাব্যথা হয় এবং তা ৪৮ ঘণ্টা বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তবে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসায় যেতে হবে বলে জানান ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী। এ ওষুধগুলো নিয়ম মেনে সেবন করলে ভালো ফল মেলে আর এর দামও খুব বেশি নয়। তবে ওষুধের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়ে জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন করার পক্ষে তিনি। অবন্তী সিঁথি যেমন গানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন, তেমনি যেকোনো রকমের ভালো লাগার কাজের জন্য সময় বের করতে হবে। শুধু নিজে অংশগ্রহণ নয়, সিনেমা দেখা, গান শোনা ইত্যাদি মনকে করতে পারে আনন্দিত ও রিল্যাক্সড। মেডিটেশনও এ ক্ষেত্রে কার্যকর। তবে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ স্বরে গান, বাদ্যযন্ত্র বাজালে বা শুনলে তা থেকে মাইগ্রেন ট্রিগার করে কি না, তা–ও খেয়াল রাখতে হবে।