প্রোটিনিউরিয়ার লক্ষণ, আক্রান্ত হলে কী করবেন
প্রস্রাবের সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে প্রোটিনিউরিয়া।
প্রোটিনিউরিয়ার লক্ষণ
প্রস্রাবে প্রোটিন গেলে খালি চোখে দেখা যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে অবশ্য অনেক বেশি পরিমাণে প্রোটিন যাওয়ার কারণে প্রস্রাব ঘোলাটে, সাদাটে ও ফেনা ফেনা হতে পারে। প্রস্রাবে প্রোটিন যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো উপসর্গ নেই। তবে শরীরে প্রোটিন কমে যাওয়ার কারণে কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে যেমন পা ফোলা, মুখ ফোলা, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, ক্ষুধামান্দ্য, অরুচি, অতিরিক্ত ক্লান্তি, অবসন্নতা ইত্যাদি।
এসব উপসর্গ কেবল তখনই দেখা যায়, যখন প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়ার কারণে শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি তৈরি হয়; অর্থাৎ মূল সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার অনেক দিন পর এসব উপসর্গ দেখা দেয়। তত দিনে রোগ অনেক জটিল আকার ধারণ করে। তাই প্রোটিনিউরিয়া হচ্ছে কি না, বোঝার জন্য নিয়মিত রুটিন পরীক্ষার বিকল্প নেই। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়মিত প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং করা উচিত।
কীভাবে বুঝবেন আপনি প্রোটিনিউরিয়ায় আক্রান্ত
ডিপস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজে প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন যাচ্ছে কি না, বোঝা যায়। টেস্ট টিউবে প্রস্রাব নিয়ে কাঠির মতো একটি জিনিস ডুবিয়ে রাখলে কাঠিতে রঙের পরিবর্তন হয়। দেখে ধারণা করা যায় প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন যাচ্ছে কি না। এটা বাড়িতে করা সম্ভব।
প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা (ইউরিন রুটিন এক্সামিনেশন) করানো হলে ধরা পড়ে প্রোটিন যাচ্ছে কি না।
যাঁদের বয়স ৪০ পেরিয়েছে এবং যাঁদের প্রোটিনিউরিয়ার ঝুঁকি বেশি, তাঁদের প্রতিবছর অন্তত একবার এ দুটি পরীক্ষার একটি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষত প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষাটি অবশ্যই করা উচিত। কারণ, রুটিন প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু প্রোটিনিউরিয়া নয়, অন্য অনেক রোগ সম্পর্কে ধারণা মেলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম যে প্রস্রাব হয়, সেটি সংগ্রহ করা ভালো।
প্রোটিনিউরিয়া ধরা পড়লে কী করবেন
প্রোটিনিউরিয়া ধরা পড়লে দ্রুত সময়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। না হলে জটিলতা বাড়ে। চিকিৎসা শুরু করার জন্য প্রথমে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে কিছু রক্ত পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাম। কিডনির প্রদাহ হলে কিডনি বায়োপসি করানোর প্রয়োজন পড়ে। কী কারণে প্রোটিনিউরিয়া হচ্ছে, সেটির ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসাপদ্ধতি।
চিকিৎসার ধরন
ওষুধের মাধ্যমে যেমন প্রোটিনিউরিয়ার চিকিৎসা হয়, তেমনি জীবনধারার বেশ কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়। প্রোটিনের ঘাটতি হওয়ার ফলে শরীরে পানি জমতে শুরু করে। তাই খাবারে লবণের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ডায়াবেটিসের তিন মাসের গড় ৭–এর নিচে নামাতে হবে। শরীরে পানি জমলে চিকিৎসক কখনো কখনো পানির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন। তবে খাবারে তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। প্রদাহ হলে স্টেরয়েড ও অন্যান্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো না হলে একসময় কিডনি ছাঁকন-ক্ষমতা হারিয়ে একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে; অর্থাৎ কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। যত বেশি মাত্রায় প্রোটিন প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, ততই দ্রুত কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। তাই প্রস্রাবে প্রোটিন যাওয়ার সমস্যা দেখা দিলে শুরুতে সতর্ক হতে হবে।
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনিউরিয়া
গর্ভকালীন প্রোটিনিউরিয়া হলে প্রি–একলাম্পসিয়া ও একলাম্পসিয়া নামের মারাত্মক রোগ হয়েছে বলে ধরতে হবে। প্রোটিনিউরিয়ার পাশাপাশি মায়ের রক্তচাপও অনেক বেশি থাকে। মায়ের প্রি–একলাম্পসিয়া হলে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। গর্ভকাল পূর্ণ হওয়ার আগে অপুষ্ট অবস্থায় শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। প্রি–একলাম্পসিয়ায় আক্রান্ত মায়ের শরীরের রক্ত ভেঙে যেতে পারে, প্লাটিলেট কমে যেতে পারে। মায়ের হৃৎপিণ্ড, কিডনি, লিভার, ফুসফুস, চোখ—এমনকি মস্তিষ্কও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মায়ের স্ট্রোকও হতে পারে। একলাম্পসিয়া হলে মায়ের খিঁচুনি কিংবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়। তাই গর্ভাবস্থায় প্রোটিনিউরিয়া ধরা পড়লে চিকিৎসকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
গর্ভবতী হলে নিয়মিত একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। প্রথম চেকআপে রক্তের কিছু জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষাও করতে দেওয়া হয়। প্রস্রাবের পরীক্ষা স্বাভাবিক থাকলেও পরবর্তী সময়ে হুট করে অস্বাভাবিকভাবে ওজন বেড়ে গেলে কিংবা মুখ-পা-হাত ফুলে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে।
গর্ভে যমজ সন্তান, মায়ের ডায়াবেটিস বা কিডনির রোগ থাকলে কিংবা টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে সন্তান গর্ভে এলে প্রি–একলাম্পসিয়ার ঝুঁকি বেশি। আগে কখনো প্রি–একলাম্পসিয়া হয়ে থাকলে সেটিও পরবর্তী সময়ে ঝুঁকির কারণ। তা ছাড়া মায়ের বয়স যদি ৩৫ বছর বা তার বেশি হয়, ওজন যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, আগের সন্তানটি যদি ১০ বছর বা তার বেশি সময় আগে জন্মে থাকে কিংবা পরিবারের কারও এই রোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে প্রি–একলাম্পসিয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেশি থাকে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কিডনি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল