কতটুকু ওজন কমলে তা দুশ্চিন্তার কারণ

নানা কারণে মানুষের শরীরের ওজন হঠাৎ কমে যেতে পারে। মডেল: কৃতিকা
ছবি: সুমন ইউসুফ

উচ্চতা অনুযায়ী প্রত্যেক সুস্থ মানুষেরই স্বাভাবিক ওজনের একটা সীমা আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ হিসাবকে বলা হয় বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই। স্বাভাবিক বিএমআই হচ্ছে ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৯। নিচের মাত্রার চেয়ে কম হলে তাকে বলে আন্ডারওয়েট বা ভগ্নস্বাস্থ্য। আবার ওপরের মাত্রার চেয়ে বেশি হলে ওভারওয়েট বা ওজনাধিক্য। এর কোনোটিই ভালো নয়।

যদি দেখা যায় কারও শারীরিক ওজন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, তখন সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। ভগ্নস্বাস্থ্য বা আন্ডারওয়েট হওয়াটাও সুস্থতার লক্ষণ নয়। স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন বজায় থাকা অবস্থায়ও যদি আপনার ওজন কমতে থাকে, তবে অবশ্যই এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

কতটুকু ওজন কমলে দুশ্চিন্তা করা দরকার? ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে কারও ওজন যদি পাঁচ কেজি কমে যায়, তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেটাকে বলে ‘সিগনিফিকেন্ট ওয়েট লস’ (উল্লেখযোগ্য ওজন হ্রাস)। এ রকম হলে অবশ্যই আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

যেসব কারণে হঠাৎ ওজন কমে

বিভিন্ন রোগের কারণে হঠাৎ ওজন হ্রাস পেতে পারে। কেবল শারীরিক রোগে নয়, মানসিক রোগের কারণেও কিন্তু ওজন কমতে পারে।

হরমোন ও বিপাকজনিত সমস্যা যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারথাইরয়েডিজম, অ্যাডিসনস ডিজিজ ও প্যান হাইপো পিটুইটারিজম ইত্যাদি রোগে ওজন কমে যায়।

দীর্ঘমেয়াদি কিছু সংক্রমণ যেমন যক্ষ্মা, কালাজ্বর, লিভার অ্যাবসেস এবং এইডস–জাতীয় রোগ হলে অল্প সময়ে ওজন কমে যাবে।

ওজন কমে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ক্যানসার। শরীরের নানা জায়গায় ক্যানসার হতে পারে, যেমন খাদ্যনালি, পাকস্থলী, কোলন, প্যানক্রিয়াস, লিভার, পিত্তথলি, পিত্তনালি, মস্তিষ্ক, নাক, কান, গলা, থাইরয়েড, ফুসফুস, কিডনি, মূত্রথলি, হাড়, রক্ত, জরায়ু, ওভারি, সারভিক্স ইত্যাদির ক্যানসার। বেশির ভাগ ক্যানসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হচ্ছে ওজন হ্রাস বা স্বাস্থ্যহানি।

ওজন হ্রাসের সঙ্গে অন্য লক্ষণ

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বারবার পানির পিপাসা পায়, ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, বেশি ক্ষুধা লাগে, খিদে সহ্য হয় না এবং তারপর ধীরে ধীরে ওজন কমে যেতে থাকে। পরিবারে ডায়াবেটিস রোগী থাকলে ঝুঁকি বেশি।

হাইপারথাইরয়েডিজম হলে ওজন হ্রাসের পাশাপাশি গরম অসহ্য লাগে, ভীষণ ঘাম হয়, ডায়রিয়া হতে পারে, অস্থিরতা ও বুক ধড়ফড় করবে।

অ্যাডিসনস ডিজিজে স্বাস্থ্যহানির পাশাপাশি দুর্বলতা, পাতলা পায়খানা ও বমি, পেটব্যথা, রক্তচাপ নেমে যাওয়া, রক্তে সোডিয়াম কমে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালো দাগ, মাথা ঘোরা ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। প্যান হাইপোপিটুইটারিজমেও এ ধরনের সমস্যার সঙ্গে ফ্যাকাশে ভাব, মাসিকের সমস্যা থাকে।

যক্ষ্মা বা টিবি আমাদের দেশে বেশ পরিচিত একটা সমস্যা। এ রোগ ফুসফুসসহ শরীরের যেকোনো অঙ্গে হতে পারে। বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে রোগীর হালকা ঘুষঘুষে জ্বর হয়ে থাকে, ওজন কমে যায় এবং খাবারে অরুচি দেখা দেয়। কোথায় যক্ষ্মা হয়েছে, সে অনুযায়ী কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত, বুকব্যথা, পেটে ব্যথা, পেটে পানি আসা, মাথাব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।

কালাজ্বর আমাদের দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়, বিশেষ করে ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগে বেশি দেখা যায়। এ রোগে দীর্ঘমেয়াদি জ্বর হয়, সঙ্গে খাওয়ার অরুচি, শরীর কালো হয়ে যাওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, ওজন হ্রাস ইত্যাদি উপসর্গ থাকে।

লিভার অ্যাবসেস হলে প্রচণ্ড জ্বর, পেটের ডান দিকে ওপরের দিকে ব্যথা, ওজন হ্রাস দেখা দেয়, কখনো জন্ডিসও দেখা দিতে পারে।

কোথায় হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে ক্যানসারের উপসর্গ। তবে সবচেয়ে দ্রুত ওজন কমে পরিপাকতন্ত্রের ক্যানসারে। খাদ্যনালির ক্যানসারে গলায় খাবার আটকাতে পারে, রক্তবমি হতে পারে। পাকস্থলীর ক্যানসারে ওপরের পেটে ব্যথা, বমি, রক্তবমি। কোলন ক্যানসারে পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত, কালো পায়খানা, রক্তশূন্যতা, নিচের পেটে ব্যথা হতে পারে, ফুলে যেতে পারে পেট। প্যানক্রিয়াসের ক্যানসার হলে ওপরে ও মাঝ পেটে ব্যথা হয়, জন্ডিস ও অরুচি হয়, বমিও হয়। লিভার ক্যানসারে পেটের ডান দিকে ওপরের দিকে ব্যথা হতে পারে, শক্ত চাকা আর জন্ডিস হতে পারে।

ফুসফুসের ক্যানসারে দীর্ঘমেয়াদি কাশি হয়ে থাকে, সঙ্গে বুকব্যথা, কাশির সঙ্গে রক্ত ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে। কিডনি ও মূত্রথলির ক্যানসারে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। জরায়ুর ক্যানসারে মাসিকের রাস্তায় বেশি রক্ত যেতে পারে, তলপেটে ব্যথা হতে পারে। ওভারির ক্যানসারে তলপেটে ব্যথা, পেটে পানি আসা, মাসিকের সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে। হাড়ে ক্যানসার হলে হাড়ে ব্যথা হয়। রক্তের ক্যানসারে ঘন ঘন জ্বর হয়, নাক বা ত্বকের নিচে রক্তপাত, বুকের হাড়ে ব্যথা হয়।

মানসিক কিছু রোগেও সিগনিফিকেন্ট ওয়েট লস (উল্লেখযোগ্য ওজন হ্রাস) হয়, যেমন অ্যানোরেকসিয়া নারভোসা। তা ছাড়া অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণেও কখনো কখনো ওজন কমে যেতে পারে।

কী করবেন

ওজন কমে যেতে থাকলে তাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখবেন, যেকোনো রোগই প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে চিকিৎসায় নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, এমনকি সেটা যদি ক্যানসারও হয়।

যাঁরা ওজন কমাতে চেষ্টা করছেন, ডায়েট বা শরীরচর্চা করছেন, তাঁরাও স্বাস্থ্যকর সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করবেন যেন স্বাস্থ্য ভেঙে না যায়, অপুষ্টি দেখা না দেয়। পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন কমাবেন।