কানে কম শোনার সমস্যায় কী করবেন

কেউ জন্ম থেকেই শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভোগেন, কারও সমস্যার সূত্রপাত পরবর্তী জীবনে। কেউ একেবারেই কানে শোনেন না, কেউ হয়তো আংশিক শোনেন। জন্ম থেকে শুনতে না পেলে কথাও শিখতে পারা যায় না, নিজের মত প্রকাশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বধিরতার এখন আধুনিক চিকিৎসা আছে, যার মাধ্যমে শ্রবণপ্রতিবন্ধীরাও সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার (এ বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয় বধির দিবস।

ছোটবেলা থেকেই সচেতন হোন

শ্রবণ থেকেই শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা তৈরি হয়। শ্রবণযন্ত্রে সমস্যা থাকলে তা যত দ্রুত নির্ণয় করে চিকিৎসা দেওয়া যাবে, ততই সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা। শিশুর জন্মের পর থেকে তার শ্রবণশক্তি লক্ষ করুন।

ঘুমন্ত শিশু জোরে হাততালির শব্দে চমকে উঠবে। জাগ্রত শিশু জোরালো কোনো শব্দে ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। জন্মের পর থেকে ২ মাস বয়স পর্যন্ত এগুলো লক্ষ করলে বোঝা যায়। ৪ থেকে ৫ মাস বয়সী শিশু কানের কাছে জোরে শব্দ হলে আড়াআড়িভাবে চোখের মণি নাড়ায়। ৬ থেকে ৭ মাস বয়সী শিশু শব্দের উৎসের দিকে ঘাড় ফেরায়।

সব সময় তার সামনে উচ্চারিত শব্দের মধ্যে সহজ কিছু সে উচ্চারণ করতে পারে এক বছর বয়স হলে, দেড় বছর হলে দুই শব্দের ছোট্ট বাক্যও বলতে পারে। এগুলো ঠিক থাকলে বোঝা যায়, তার শ্রবণতন্ত্র ভালো আছে।

এই বিষয়গুলোতে অসামঞ্জস্য লক্ষ করলে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন অতিসত্বর। বেড়ে ওঠার সময়ে শিশুর সঙ্গে কথা বলা এবং তাকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়াও জরুরি, না হলে শ্রবণতন্ত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও শিশু কথা ঠিকমতো শেখে না।

শিশুর শ্রবণযন্ত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থায় মায়ের যত্ন নিশ্চিত করুন। গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ সেবন, ভাইরাস সংক্রমণ, এক্স-রে বা বিকিরণ গর্ভস্থ শিশুর বধিরতার ঝুঁকি বাড়ায়। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে কিংবা মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ (যে ক্ষেত্রে বাবার রক্তের গ্রুপ পজিটিভ এবং সন্তানেরও তাই) হলে, অপরিণত নবজাতক জন্ম, জন্মের সময় নবজাতকের মস্তিষ্কে আঘাত কিংবা গর্ভাবস্থায় যদি গর্ভপাতের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে জন্মের পর শিশুটি বধির হতে পারে।

শব্দদূষণ কমাতে হবে

শব্দদূষণের কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যার পাশাপাশি শ্রবণের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শ্রবণক্ষমতা কমতে কমতে ব্যক্তি একেবারে বধিরও হয়ে যেতে পারেন। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রাদির উচ্চমাত্রার কর্কশ শব্দ, শ্যালো মেশিন, এমনকি ওয়াকম্যানের উচ্চমাত্রার শব্দও শ্রবণযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। নির্মাণশ্রমিক, উচ্চ শব্দের যন্ত্রচালনাকারী, ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি, ব্যান্ড দলের বাদক-গায়ক (এমনকি সামনের সারিতে বসা ব্যান্ডসংগীতের শ্রোতা), পথচারী, গাড়িচালক, গাড়ির যাত্রী কিংবা ব্যস্ত সড়কের পাশে যাঁদের বাড়ি, দোকান বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাঁরা সাধারণত শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

প্রয়োজন ছাড়া হর্ন ব্যবহার করা যাবে না। আর পেশাগত কারণে উচ্চ শব্দে থাকতে হলেও তা যেন দৈনিক ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার বেশি না হয়। ওই সব কর্মস্থলে কর্মরত ব্যক্তির কানকে দেওয়া উচিত বিশ্রাম। হেডফোন যদি ব্যবহার করতেই হয়, হেডফোনের শব্দ সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং ৩০ মিনিট অন্তর ৫ মিনিট করে বিরতি দিতে হবে। উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে অবস্থান করলে ‘এয়ার প্লাগ’ ব্যবহার করতে পারেন। বিকল্প হিসেবে তুলা তেলে ভিজিয়ে চিপড়ে কানে গুঁজে রাখুন।

এ ছাড়া দুর্ঘটনাক্রমে কান বরাবর প্রচণ্ড আঘাত পেলেও শ্রবণশক্তি হ্রাস হতে পারে।

শ্রবণতন্ত্রে সমস্যা

শ্রবণতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের সমস্যায় শ্রবণশক্তি কমে। কানের খৈল বা ওয়াক্স, বাহির থেকে কিছু কানের ভেতর প্রবেশ, ফোড়া বা টিউমার, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস সংক্রমণ (হাম, রুবেলা, মাম্পস, চিকেন পক্স প্রভৃতি), কানের স্নায়ুর সমস্যা, মধ্যকর্ণে প্রদাহ, অন্তঃকর্ণে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটা কিংবা নাক ও মধ্যকর্ণের সংযোগকারী নালির কোনো সমস্যায় শ্রবণশক্তি কমতে পারে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেও শ্রবণশক্তি কমতে পারে, বিশেষত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস প্রভৃতি থাকলে।

ওষুধ ব্যবহারে সতর্কতা

একবার হয়তো কোনো কারণে চিকিৎসক কানের ড্রপ লিখেছিলেন, তারপর বারবার না বুঝে কানের কোনো সমস্যায় সেটা ব্যবহার করা ঠিক নয়। ওষুধের দোকানদারও না বুঝে কানের ড্রপ দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এগুলো একেবারেই অনুচিত। মনে রাখবেন, কানের মূল সমস্যা না জেনে ড্রপ ব্যবহারে সাময়িক উপশম হলেও পরবর্তী সময়ে বারবার ব্যবহারে শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে।

সমস্যায় পড়লে কী করবেন

শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক যে কারও শ্রবণশক্তি কমে গেলে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন যত দ্রুত সম্ভব। বাংলাদেশে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি বর্তমান। শ্রবণে সাহায্যকারী কোষগুলো কার্যকর থাকলে কানে শোনার যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। বাইরে থেকে যন্ত্রের উপস্থিতি বোঝা যায় না, এমন যন্ত্রও রয়েছে। তবে শ্রবণতন্ত্রের অন্তঃকর্ণের স্নায়ুকোষ কার্যকর না থাকলে অস্ত্রোপচার (ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট) করার প্রয়োজন পড়ে।

জন্ম থেকে বধির ব্যক্তির অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসার আরও কিছু ধাপ পেরোতে হয়, যা ক্রমান্বয়ে শ্রবণশক্তিকে ফিরিয়ে জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করবে। শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি অভিভাবকের মিথস্ক্রিয়া (শিশুর চোখে চোখ রেখে বেশি বেশি কথা বলা এবং ডিজিটাল ডিভাইস, কার্টুন, অ্যানিমেশন, গান ও ভিন্ন ভাষার ভিডিও এড়িয়ে চলা) খুবই জরুরি। সামাজিকভাবে ও শিক্ষাব্যবস্থাতেও মূক-বধির শিশুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

অনুলিখন: ডা. রাফিয়া আলম