ছোটবেলার যৌন হয়রানি আর বর্তমানের বিচ্ছেদে ভেঙে পড়েছি

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মেহতাব খানম

প্রশ্ন: আমার বয়স ২০ বছর, মেয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় যৌন হয়রানির শিকার হই। বিষয়টি তখন বুঝতে না পারলেও যখন বুঝতে পেরেছি আমার সঙ্গে কী হয়েছে, সেই থেকে আজ পর্যন্ত সেই স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। দীর্ঘ সাত বছরে আমি অনেকবার আত্মাহুতির কথাও ভেবেছি।

২০১৮ সালে একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রথম প্রথম খুব ভালো চলছিল। আমি লক্ষ করেছিলাম, আগের স্মৃতিগুলো তখন কিছুটা হলেও কম মনে পড়ত। কিন্তু কয়েক মাস যেতেই আমার প্রতি সেই ছেলের অবহেলা শুরু হয় এবং প্রচণ্ড খারাপ ব্যবহার শুরু করে সে। কিন্তু সেই ছেলের প্রতি একটা আবেগ ও দুর্বলতার কারণে আমি তাকে ছাড়তে পারছিলাম না। করোনার আগপর্যন্ত তার সঙ্গে আমার প্রায় নিয়মিত দেখা হতো। করোনা বিধিনিষেধের সময় তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়। গত জানুয়ারি মাসে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয়।

যদিও তার সঙ্গে আমার এখন যোগাযোগ নেই, তবু আমার প্রতি তার দুর্ব্যবহার ও আমার আগের সেই বাজে স্মৃতি রোজ আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। আমার কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না, কেউ কথা বলতে চাইলেও ভালো লাগে না, পড়ালেখা বা কোনো কিছুই মন দিয়ে করতে পারি না। শেষ রাতের আগে ঘুম আসে না, যদি কখনো আগে ঘুমিয়ে যাই, তাহলে স্বপ্নের মধ্যেও সেই স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে এবং ঘুম ভেঙে যায়। আমি জানি আত্মহত্যা ভালো নয়, যা আমি করতে চাই না, কিন্তু প্রতিনিয়ত আমার মধ্যে শুধু এটা করার ইচ্ছা তৈরি হয়। আমার এই অবস্থার কথা অনেকবার আমার পরিবারকে বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু বলতে গিয়েও পারিনি।

আমার এই অবস্থাকে কি ডিপ্রেশন বলে? আমি সব ভুলে একজন সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষ হতে চাই, সামনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা আমি আমার লেখাপড়ায় মন দিতে চাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: অতীতের অত্যন্ত কষ্টকর, ভীতিকর ও প্রতারণার অভিজ্ঞতা তোমাকে এমন একটি মানসিক অবস্থায় নিয়ে গেছে যে একে মোকাবিলা করাটা তোমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। তুমি প্রশ্ন করেছ, এটিকে ডিপ্রেশন বলা যায় কি না। বর্তমানে যে উপসর্গগুলো খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছ অত্যন্ত প্রঞ্জল ভাষায়, সেটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

বর্ণনা পড়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি যে তুমি হয়তো পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছ। এই অসুস্থতায় দেখা যায় আমরা একই সঙ্গে বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা বা ভয় এবং রাগের অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাই। যে ব্যাপার নিয়ে আমার মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করছে, তা হচ্ছে তুমি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছ। এই অসুস্থতা সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে ইন্টারনেটে ঢুকে এর কারণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে পড়ে দেখতে পারো। তাতে তুমি কী ধরনের চিকিৎসা সহায়তা নেবে, সে ব্যাপারেও একটি পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারবে।

দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হচ্ছে, তুমি শৈশবের তিক্ত স্মৃতি বয়ে বেড়াতে গিয়ে অনেক আগে থেকেই বিশাল একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিলে। জানি না নিজেকে সে জন্য কতটা দায়ী করে প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছিলে। নাকি যে মানুষ তোমার এই ভয়ংকর ক্ষতি করেছে, তার প্রতি রাগ ও ক্ষোভ অনেক বেশি জমেছে? পরবর্তী সময়ে তোমার মনোজগতে যা–ই কাজ করুক, তুমি যে নিজেকে আর ভালোবাসতে পারোনি, তা বোঝা যাচ্ছে। সেই কারণেই বারবার নিজেকে আঘাত করছ। হয়তোবা শৈশব থেকেই তুমি বেশ কষ্ট পেয়েছ এবং একাকিত্বে ভুগেছ, আর সে কারণে যে মানুষের সঙ্গে ভা‌লোবাসার সম্পর্ক হয়েছিল, তার প্রতি মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলে।

ছেলেটির অসম্মান, অবহেলা তোমাকে অনেক বেশি মানসিক যন্ত্রণা দিলেও তুমি তাকে আঁকড়ে ধরে একটু নিশ্বাস ফেলে বাঁচতে চেষ্টা করেছিলে। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি যখন অজুহাত দেখিয়ে বিদায় নিয়েছে, তখন আবার নিঃসঙ্গ জীবনে তোমাকে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হয়েছে। শৈশবে এবং পরবর্তী জীবনে পাওয়া কষ্টগুলোর সঙ্গে গত জানুয়ারিতে ছেলেটিকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট যুক্ত হয়ে তোমার মনঃপীড়া আরও তীব্র হয়েছে। যেহেতু পরিবারের কাছের মানুষদের সঙ্গে তুমি খুব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে পারোনি, তাই নিজের মধ্যেই সেগুলো বয়ে বেড়াতে হয়েছে। তোমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আছে কি না, জানি না।

দুঃসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে আমাদের মনের ভার কিছুটা হলেও লাঘব হয়। যেহেতু বাইরের পৃথিবী বা মানুষদের নেতিবাচক আচরণ পরিবর্তনের জন্য আমরা কিছুই করতে পারি না, তাই নিজের ভেতরে কিছুটা স্বস্তি তৈরি করার লক্ষ্যে সাইকোথেরাপিস্টরা সহায়তা করতে পারেন। তোমার ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কিছু ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হবে এবং সেই সঙ্গে একটু দীর্ঘ সময় ধরে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির সহায়তাও গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অর্থাৎ যাঁরা ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, তাঁদের কারও কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করার জন্য তুমি সরকারি হাসপাতালে যেতে পারো। পাশাপাশি সাইকোথেরাপির সাহায্য নিতে পারো। কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে থাকে।

আশা করছি, ওষুধের পাশাপাশি থেরাপির সাহায্য আগামী দিনগুলো ফলপ্রসূভাবে কাটাতে তোমাকে সহায়তা করবে।

ঘোষণা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫।

(খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA