জনপ্রিয় হচ্ছে 'হৃদয়ের তেল'

‘রাইস ব্রান অয়েল’-এর মধ্যে বাজারে ফরচুন ব্র্যান্ডের তেল বেশ জনপ্রিয়। ছবি: সংগৃহীত
‘রাইস ব্রান অয়েল’-এর মধ্যে বাজারে ফরচুন ব্র্যান্ডের তেল বেশ জনপ্রিয়। ছবি: সংগৃহীত

একসময়ের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ওঠার পথে। সেই উন্নতির সোপানে উঠতে আমাদের দৈনন্দিন জীবন কাটছে চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে। সফলতার মুখ দেখতে মানসিক চাপ, কর্মক্লান্তি, আবেগ-অবসাদ আর কষ্ট শুষে নেওয়ার সঙ্গে আমাদের লড়াইটা প্রতিদিনের। আর তাই এ দেশের মানুষের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও অনেক বেশি।
দেশীয় চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ২৭ ভাগ মৃত্যুর কারণ হলো করোনারি (হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনি) হৃদ্‌রোগ। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের পাশাপাশি এ রোগের অনেক কারণ আছে। দৈনন্দিন জীবনে হু হু করে বেড়ে চলা চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা, কর্মক্ষেত্রে চাপ, খাদ্যাভ্যাস। এসব বিষয় সরাসরি প্রভাব ফেলে ‘কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম’-এ।
মানুষের সচেতনতা বাড়ছে; বাড়ছে বিকল্প। নিয়মিত ভোজ্যতেলের পাশাপাশি বিকল্প তেল এখন বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের বাজারে এ তেলের নাম ‘রাইস ব্রান অয়েল’। জাপানে অনেকে বলেন ‘হার্ট অয়েল’, মানে হৃদয়ের তেল!
ধানের তুষ ফেললে যে চাল পাওয়া যায়, তার ওপর একটি লালচে খোসা থাকে। এই খোসাই কুঁড়া বা ‘রাইস ব্রান’। ধান থেকে চাল তৈরির সময় শতকরা ৮ থেকে ১০ ভাগ কুঁড়া পাওয়া যায়। ধানের তারতম্য ভেদে এসব কুঁড়ায় শতকরা ১৫-২০ ভাগ অপরিশোধিত তেল থাকে। সেটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিশোধনের পর বোতলজাত করে বিপণন করা হয়।
হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে এ তেলের জুড়ি মেলা ভার। এ জন্য সয়াবিন তেল ছেড়ে অনেকেই ঝুঁকছেন ‘রাইস ব্রান অয়েল’-এর দিকে। প্রায় শতভাগ কোলেস্টেরল-মুক্ত এ তেল হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে বেশ কার্যকর। আসুন, জেনে নিই ‘রাইস ব্রান অয়েল’-এর কিছু বিশেষ গুণাগুণ—

হৃৎপিণ্ডবান্ধব
ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি তেলে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ‘ওরাইজ্যানল’ পাওয়া যায়। রয়েছে ভিটামিন ‘ই’—‘টকোট্রিয়েনল’। এ দুটি উপাদান ‘ফ্যাট মলিকিউল’ ও ‘ট্রাইগ্লিসারাইড’ নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমানোর পাশাপাশি ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়িয়ে থাকে। এ ছাড়া তেলটির দুটি উপাদান ‘মুফা’ (মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) ও ‘পুফা’ (পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) রক্তনালিতে রক্তের প্রবাহও বাড়ায়। ‘পুফা’য় রয়েছে ওমেগা-৬ আর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। পুষ্টিবিজ্ঞান বলছে, যেকোনো খাবারে ওমেগা-৬ আর ওমেগা-৩ থাকা চাই নির্দিষ্ট অনুপাতে। ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি তেলে এ দুটি ফ্যাটি অ্যাসিডের হার প্রায় সমানুপাতিক।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ‘আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর মতে, শরীরে ভালো কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) পরিমাণ বাড়াতে ‘রাইস ব্রান অয়েল’ হতে পারে সেরা পছন্দ। ‘ওরাইজ্যানল’ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট দেহে কোলেস্টেরল শোষণের মাত্রা কমিয়ে বিতাড়নের মাত্রা বাড়াতে দারুণ কার্যকর। সর্বোপরি হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায় এ তেল খুবই উপকারী।

ভরপুর ভিটামিন ‘ই’
ভিটামিন ‘ই’ শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি এ তেলটি ভিটামিন ‘ই’তে সমৃদ্ধ। এ ভিটামিনের ‘অ্যান্টি-মিউটাজেনিক’ উপাদান ক্যানসার প্রতিরোধী। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও ভিটামিন ‘ই’ মানে এ তেলের ওপর ভরসা রাখতে পারেন। বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান এ আই মোস্তফার মতে, খাবার তেলে যেসব খাদ্যগুণ থাকা উচিত, তার সবদিক বিবেচনায় জলপাই তেলের পর সবচেয়ে ভালো ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি তেল। সয়াবিন তেলের তুলনায় এ তেল অনেক ভালো এবং স্বাস্থ্যকর।

চর্মরোগ কমায় ও ওজন নিয়ন্ত্রণ
ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি করা তেলে রয়েছে প্রাকৃতিক ৩০-কার্বন ‘স্কোয়ালেন’। এটি শরীরের চামড়ার মধ্যকার দূষণ প্রতিরোধ করে চামড়া নরম ও মসৃণ রাখে। তা ছাড়া আরও কিছু প্রাকৃতিক উপাদান থাকায় চর্মরোগও প্রতিরোধ করে ‘রাইস ব্রান অয়েল’। প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় শরীরে এ তেল পরিপাক ক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে বেশ কাজ করে এ তেল। ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’ আর ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় এ তেল আমাদের দাঁত, চোখ ও হাড়ের জন্যও খুবই উপকারী।

স্মোকিং পয়েন্ট
রান্নার তেল কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় গুণাগুণ নষ্ট হওয়া শুরু হয়—এটাই ‘স্মোকিং পয়েন্ট’। তেলের স্বাস্থ্যগত গুণাগুণ সঠিকভাবে পেতে এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গবেষণায় দেখা গেছে, জলপাই তেলের ‘স্মোকিং পয়েন্ট’ ৩৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। অর্থাৎ এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় তেলটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি তেলের ‘স্মোকিং পয়েন্ট’ ৪৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। অর্থাৎ উচ্চ তাপমাত্রার রান্নাতেও এ তেলের গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম।