জ্বর মানেই করোনা নয়

জ্বর একটি সাধারণ অসুখ—আপাতদৃষ্টিতে সবারই ধারণা এমন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সাধারণ এই জ্বরকে ভয়াবহ করে তুলেছে। আর করোনা মহামারি জ্বরের ভয়াবহতাকে নিয়ে গিয়েছে চরমে। সাধারণ জ্বর হলেও আজকাল সবাই ভয়ে থাকে করোনা সংক্রমণ নিয়ে।

জ্বরের নানা উপসর্গ, কারণ ও প্রতিকার নিয়ে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘ইজোরাল মাপস স্বাস্থ্য আলাপন’। অনুষ্ঠানটির একাদশ পর্বে আলোচ্য বিষয় ছিল ‘জ্বর মানেই করোনা নয়’। এভারকেয়ার হসপিটালস ঢাকার প্রিন্সিপাল ডায়েটিশিয়ান তামান্না চৌধুরীর সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ডা. এ বি এম সফিউলাহ কবির, কনসালট্যান্ট, ইন্টারনাল মেডিসিন, ইমপালস হাসপাতাল।
অনুষ্ঠানটি ২৪ জানুয়ারি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

এভারকেয়ার হসপিটালস ঢাকার প্রিন্সিপাল ডায়েটিশিয়ান তামান্না চৌধুরীর সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ডা. এ বি এম সফিউলাহ কবির, কনসালট্যান্ট, ইন্টারনাল মেডিসিন, ইমপালস হাসপাতাল

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডা. এ বি এম সফিউলাহ কবির আলোচনা করেন সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বর ও করোনার উপসর্গ নিয়ে। তিনি বলেন, জ্বর, ঠান্ডা, কাশি সাধারণত ঋতুভিত্তিক রোগ। আবার মহামারি রোগ করোনার প্রধান উপসর্গও এগুলো। এ জন্য জানতে হবে কোনটি করোনা আর কোনটি সাধারণ ভাইরাসজনিত অসুখ। করোনার উপসর্গের চারটি ধাপ রয়েছে; ডাক্তারি ভাষায় যেগুলোকে বলা হয় ১. ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেস, ২. মাইল্ড, ৩. মডারেট এবং ৪. সিভেয়ার। এর প্রথম ধাপে করোনা এবং সাধারণ ভাইরাস জ্বর আলাদা করা খুবই কষ্টসাধ্য। এ জন্য প্রাথমিকভাবে জ্বর হলে ভয় না পেয়ে ঘরেই চিকিৎসা করতে হবে।

প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। কাশি থাকলেও ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। কিংবা অ্যান্টিহিস্টামিন–জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে জানতে হবে, কত দিন পর্যন্ত আমরা এই চিকিৎসা চালিয়ে যাব। চার থেকে পাঁচ দিন এই চিকিৎসা চালানো যাবে। অর্থাৎ সাধারণ ভাইরাস জ্বর হলে এই সময়ের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু যদি করোনা হয়, তবে তা ভালো নাও হতে পারে। আবার কারও যদি এরই মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়, তবে ধরেই নেওয়া যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত। তখন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে যাঁদের আগে থেকেই অ্যাজমা বা হাঁপানি রয়েছে, তাঁরা জানেন, শীতের সময় এর প্রকোপ বেড়ে যায়। শীতের সময় অ্যাজমা রোগীরা সাধারণভাবেই ইনহেলার ব্যবহার করেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নতুন করে অ্যাজমায় আক্রান্ত হন। এ অবস্থাটা ঝুঁকিপূর্ণ। আবার অ্যাজমা রোগীরা যদি করোনায় আক্রান্ত হন, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা অনেক বেশি।

আমাদের দেশে অনেক রোগীদের মধ্যে একটি ভয় আমি লক্ষ করেছি। সাধারণ জ্বরে তাঁরা করোনা পরীক্ষা করাতে রাজি নন। তাঁদের ধারণা, তাঁরা যদি করোনায় আক্রান্ত নাও হন, তবে পরীক্ষা করাতে গেলে অবশ্যই করোনায় আক্রান্ত হবেন। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক সমাধান হচ্ছে, তাঁরা কিছু সাধারণ ল্যাব টেস্ট করাতে পারেন। যেগুলো করোনা চিকিৎসার গাইডলাইনে বলা আছে, যেমন সিডিসি, সিআরপি ইত্যাদি টেস্ট করাতে পারেন। আর যদি সঙ্গে শ্বাসকষ্ট থাকে, তবে একটি এইচআর সিটিস্ক্যান করানো যেতে পারে। এগুলো হচ্ছে সরাসরি করোনা টেস্টের বিকল্প উপায়।

বিশেষ করে এইচআর সিটিস্ক্যানে যদি দেখা যায় নিউমোনিয়ার লক্ষণ রয়েছে, তবে গাইডলাইন অনুযায়ী এ ধরনের রোগীকে করোনায় আক্রান্ত ধরে চিকিৎসা শুরুর নির্দেশ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ না দিলেই নয়; আমার এক রোগীর করোনা পরীক্ষায় দেখা গেল তিনি করোনামুক্ত, কিন্তু উপসর্গ রয়েছে। পরে তাঁকে এইচআর সিটিস্ক্যান করোনো হলে দেখা গেল, তার নিউমোনিয়ার লক্ষণ রয়েছে। সুতরাং বলা যায়, করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি এই পরীক্ষাগুলোরও বিশেষ কার্যকারিতা আছে। এ জন্য চিকিৎসকেরা এই পরীক্ষাগুলো করানোর বিষয়ে পরামর্শ দেন।

এরপর কনসালট্যান্ট ডা. এ বি এম সফিউলাহ কবির আলোচনা করেন করোনা রোগের সময়সীমা নিয়ে। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কত দিন পর আবারও করোনা পরীক্ষা করানো উচিত, সেটা কিছুটা কষ্টসাধ্য বলে উল্লেখ করেন তিনি। কারণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে করোনা ১৪ দিন পর নেগেটিভ আসে, আবার ২১ দিন পরও নেগেটিভ হতে পারে। যেসব রোগীর বয়স বেশি বা আগে থেকে কোনো ধরনের জটিল রোগ ছিল বা অ্যাজমা ছিল, এমন রোগীদের দুই বা তিন সপ্তাহ পরও পজিটিভ হচ্ছে। এগুলো হয় ডেড ভাইরাসের জন্য। তিন সপ্তাহ পর রোগীর যদি আর কোনো উপসর্গ না থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি করোনামুক্ত।

কিন্তু অনেক সময় ডেড ভাইরাসের জন্যও পরীক্ষার ফল পজিটিভ দেখায়। এসব ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোগীর কোনো ধরনের লক্ষণ আছে কি না, সেটা দেখা। যদি কোনো ধরনের লক্ষণ না থাকে, তবে তিনি সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত। আবার এর উল্টোও দেখা যায়। অনেকের পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছে, কিন্তু রোগীর জোরালো উপসর্গ রয়েছে। যেমন: শ্বাসকষ্ট, কাশি ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহ পরও রোগী অক্সিজেন গ্রহণ করছে, এমন অবস্থায় পরীক্ষা করালে নেগেটিভ আসছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা রোগীকে ঝুঁকিমুক্ত বলতে পারি না। এমনকি রোগী পুরোপুরি ক্লিনিক্যালি সুস্থ না হয়ে উঠলে ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না।