ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় কী

ছোটবেলায় পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা–ই নিয়েই আমাদের সমাজ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের ধারণাও পাল্টে যায়। এখন আমার কাছে সমাজ মানে হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন রকমের সম্পর্কের নেটওয়ার্ক। সম্পর্কের ভিত্তিতে এখানে কেউ আমাদের মা-বাবা, কেউ আমাদের ভাই-বোন, কেউ আমাদের বন্ধু-বান্ধবী, কেউ স্ত্রী, কেউ স্বামী, কেউ আমাদের নিকটাত্মীয়, কেউ আমাদের প্রতিবেশী।

ধর্ষণকে না বলুন
ছবি: প্রথম আলো

মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সৌন্দর্য ও সুস্থতার ওপর পারিবারিক, সামাজিক কল্যাণ সর্বোপরি দেশের কল্যাণ ও শৃঙ্খলা গভীরভাবে সম্পর্কিত। সুন্দর ও স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করা এবং সেই সম্পর্ক রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক নীতি–নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রধান নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। যে পরিবার ও সমাজের মানুষের ভেতর কিংবা পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অনুশীলন কম, সেখানকার সম্পর্কগুলো দিন দিন অস্বাভাবিক ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।

নারীর প্রতি বিভিন্ন রকম সহিংসতা আমাদের সমাজে একটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। নারীরা পরিবারের বাইরে যে পরিমাণ সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তার চাইতে অনেক গুণ বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে পরিবারের ভেতরেই, যার অধিকাংশ ঘটনা বিভিন্ন কারণে প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশে ৭৭ শতাংশ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে পরিবারের মধ্যে

মানুষের ভেতর মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার বিকাশ যথাযথভাবে না হওয়া এবং এর ধারাবাহিক অবক্ষয়ের সঙ্গে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মেশানো, সিন্ডিকেট তৈরি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে লাগামহীন দুর্নীতি ইত্যাদি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূল্যবোধ ও নীতি–নৈতিকতার চর্চার অভাব যে শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোকে দূষিত করে তা নয়, বরং মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবেশকেও ধীরে ধীরে দূষিত করে ফেলে। যে কারণে আমাদের দেশে অনেক দিন ধরে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যকার দূষণটা বেশ প্রকট আকার ধারণ করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন ইভটিজিং, অ্যাসিড নিক্ষেপ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদিকে সেই লিঙ্গগত সম্পর্কের ভেতরকার দূষণের ফল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

নারীর প্রতি বিভিন্ন রকম সহিংসতা আমাদের সমাজে একটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। নারীরা পরিবারের বাইরে যে পরিমাণ সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তার চাইতে অনেক গুণ বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে পরিবারের ভেতরেই, যার অধিকাংশ ঘটনা বিভিন্ন কারণে প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশে ৭৭ শতাংশ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে পরিবারের মধ্যে (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০১৮)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাদের কাছের মানুষ দ্বারা। ছেলে ও মেয়েশিশুসহ বিভিন্ন বয়সী নারীর ওপর ধর্ষণের ঘটনা কয়েক দশক ধরে এতই বেড়ে গেছে যে এর প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে মানুষ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মানুষ ধর্ষকের কঠোর শাস্তির দাবি তুললেও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে সেটাই একমাত্র সমাধান নয়। কারণ, ধর্ষণ একটি অপরাধমূলক আচরণ এবং সেই আচরণের প্রাথমিক ভিত্তি হলো নারীর প্রতি ক্রমান্বয়ে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ও বিকৃত চিন্তাপ্রক্রিয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি।

এ ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষণ নামক আচরণকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, ধর্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত নেতিবাচক ও বিকৃত চিন্তাপ্রক্রিয়াকে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। নারীর প্রতি নেতিবাচক ও বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সংশোধন করতে হবে। সেই চিন্তাগত সংশোধন প্রক্রিয়ায় মূল্যবোধের শিক্ষা নিঃসন্দেহে প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে।

আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ভেতর যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তার পেছনে মূলত কাজ করছে মানুষের নেতিবাচক চিন্তাপ্রক্রিয়া ও আচরণ। মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায় যে মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়া ও আচরণ কেমন হবে, তার প্রাথমিক ভিত্তি ছোটবেলায় তৈরি হয়ে যায়। মানুষের পরবর্তী জীবনের চিন্তার ধরনে ও আচরণে নানা রকম নিয়মিত পরিবর্তন এলেও ছোটবেলায় তৈরি হওয়া প্রাথমিক ভিত্তিমূল প্রায় অপরিবর্তনীয় থেকে যায়।

ছবি: প্রথম আলো

সহজভাবে বলতে গেলে, ছোটবেলায় তৈরি হওয়া মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়া ও আচরণের প্রাথমিক ভিত্তি অনেকটা কাদামাটির মতো, অর্থাৎ যে রূপ দেবেন, সে রূপই ধারণ করবে। মানুষের চিন্তা ও আচরণের সেই প্রাথমিক ভিত্তির স্বরূপ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষণপ্রক্রিয়া। অন্যদিকে সেই শিক্ষণপ্রক্রিয়ার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা। কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক, কোন আচরণ করা উচিত, কোন আচরণ করা উচিত নয়, কোনটা চিন্তা করা উচিত, কোনটা চিন্তা করা উচিত নয় ইত্যাদি শিক্ষণপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুর ভেতর মূল্যবোধের মাপকাঠি তৈরি হতে থাকে।

মূল্যবোধের সেই মাপকাঠির ওপর ভিত্তি করে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণের সক্ষমতা একজন মানুষের ভেতর ছোটবেলা থেকেই চেতন ও অবচেতনভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হয়। পার্থক্য নিরূপণের এই সক্ষমতা ছোটবেলা থেকে ঠিকঠাকভাবে বিকশিত না হলে, বড়বেলায় এসে আপনি যতই আইনকানুনের নিষেধাজ্ঞা দেখান না কেন, যত বড়ই শাস্তির ভয় দেখান না কেন, অপরাধপ্রবণতা মানুষের চিন্তা ও আচরণের গভীরে জেঁকে বসে এবং স্থান, কাল, পাত্রভেদে সুযোগ পেলেই সেই অপরাধপ্রবণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার ভিত্তি তৈরিতে ও বিকাশে আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

ছবি: প্রথম আলো

মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায়, যেসব পুরুষ ছোটবেলায় বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হয়, অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা যথাযথভাবে পায় না, পিতা-মাতার সঙ্গে দুর্বল পারিবারিক বন্ধনের ভেতর দিয়ে যায়, আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা পায় না এবং নেতিবাচক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে বড় হয়, তাদের ভেতর ভ্যালুজ সিস্টেম বা মূল্যবোধ ভালোভাবে বিকশিত হয় না। ফলে তাদের চিন্তাপ্রক্রিয়া ও আচরণ জৈবিক বা আদিম প্রবৃত্তি দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণ হলো সেই জৈবিক প্রবৃত্তিরই বহিঃপ্রকাশ।

আত্মস্বীকৃত ধর্ষকদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় সবার মধ্যেই তিনটি সাধারণ মানসিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে। প্রথমত, ধর্ষকেরা অন্যের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল নয়, অর্থাৎ অন্যের ভালো লাগা কিংবা খারাপ লাগার অনুভূতিকে তারা পাত্তা দেয় না। নিজেদের অনুভূতির ওপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দ্বিতীয়ত, তারা খুবই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। নিজের আনন্দ লাভের জন্য ন্যায়-অন্যায়কে উপেক্ষা করে সবকিছুই করতে প্রস্তুত থাকে। তৃতীয়ত, নারীদের প্রতি একধরনের হিংসাত্মক মনোভাব মনের গভীরে লালন করে। এই তিন বৈশিষ্ট্যই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একজন মানুষের ভেতর পারিবারিক, সামাজিক ও যৌন মূল্যবোধের অনুপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্রথমত, ধর্ষকেরা অন্যের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল নয়, অর্থাৎ অন্যের ভালো লাগা কিংবা খারাপ লাগার অনুভূতিকে তারা পাত্তা দেয় না। নিজেদের অনুভূতির ওপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দ্বিতীয়ত, তারা খুবই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। নিজের আনন্দ লাভের জন্য ন্যায়-অন্যায়কে উপেক্ষা করে সবকিছুই করতে প্রস্তুত থাকে। তৃতীয়ত, নারীদের প্রতি একধরনের হিংসাত্মক মনোভাব মনের গভীরে লালন করে।

এসব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও ধর্ষকদের ভেতর একধরনের চিন্তাগত বিকৃতি কাজ করে। যেমন লিঙ্গগত সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন ভুল বিশ্বাস লালন করে, নারীদের শুধু যৌনসুখপ্রাপ্তির উৎস হিসেবে দেখে, নারীদের বিপজ্জনক হিসেবে মূল্যায়ন করে। ধর্ষকদের ওপর পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষকেরা নিজেদের সমস্যা সৃষ্টিকারী ও খারাপ লোক হিসেবে বিবেচনা করে না। এটা শুনতে অবাক লাগলেও আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ ধর্ষকদের ভেতর মূল্যবোধ নামক সিস্টেমই ঠিকঠাকভাবে তৈরি হয় না, যার ওপর ভিত্তি করে ভালো-মন্দ বিচার করবে তারা।

এ ছাড়া দেখা গেছে, যেসব ধর্ষক তাদের অপরাধমূলক আচরণের জন্য অনুতপ্ত হয়, পরবর্তীকালে তাদের এ ধরনের গর্হিত আচরণ কমে যায়। অন্যদিকে যেসব ধর্ষক ধর্ষণের জন্য ভিকটিমকে দায়ী করে, তাদের ভেতর কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ কাজ করে না। ফলে একই ধরনের আচরণ পরবর্তীকালে আরও করার সম্ভবনা থাকে। অধিকাংশ ধর্ষকের মধ্যে সমাজবিরোধী কাজকর্ম করার প্রবণতা দেখা যায় এবং ধর্ষণ করার সময় তারা কখনো অপরাধমূলক আচরণের জন্য নির্ধারিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শাস্তির কথা ভাবে না। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজ করার পর সেটার জন্য অনুতাপ করা না করা এবং অপরাধপ্রবণতা সম্পূর্ণভাবে মানুষের ভ্যালুজ সিস্টেম বা মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ, মূল্যবোধের অপর নাম বিবেক।

যেসব ধর্ষক তাদের অপরাধমূলক আচরণের জন্য অনুতপ্ত হয়, পরবর্তীকালে তাদের এ ধরনের গর্হিত আচরণ কমে যায়। অন্যদিকে যেসব ধর্ষক ধর্ষণের জন্য ভিকটিমকে দায়ী করে, তাদের ভেতর কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ কাজ করে না। ফলে একই ধরনের আচরণ পরবর্তীকালে আরও করার সম্ভবনা থাকে।

নারী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যকার সহিংসতা কমাতে হলে পারিবারিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার ভিত তৈরি করতে হবে। পরিবারের ছোটদের ভেতর মূল্যবোধের বীজ বপন করতে হলে বড়দের প্রাত্যহিক জীবনে সেটার অনুশীলন থাকতে হবে। কারণ, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদির চাইতে শিশুরা দেখাদেখি, অর্থাৎ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভালো শেখে।

ছবি: প্রথম আলো

এ ক্ষেত্রে পরিবারের হাত ধরেই শিশুরা শিখবে অন্যের অনুভূতিকে কীভাবে গুরুত্ব দিতে হয়, নিজেদের নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে জানবে—সব লিঙ্গ, পেশা, জাত ও ধর্মের মানুষকে কীভাবে সম্মান করতে হয় এবং নিজের ও আশপাশের মানুষের জীবনের দায়িত্ব কীভাবে নিতে হয়।

লেখক: মনোবিজ্ঞানী ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত