নিজের বিপদ ডেকে আনছেন না তো!

মুটিয়ে যাওয়া মানে অতি স্থূলতা। ইংরেজিতে ‘ওবেসিটি’। এটি শরীরের এক বিশেষ অবস্থা, যে অবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত স্নেহ বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হয়। অতি স্থূলতাকে রোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। অতিরিক্ত মোটা হয়ে গেলে স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। হৃদ্‌রোগ ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, কয়েক ধরনের ক্যানসার এবং ‘অস্টিওআর্থারাইটিস’ রোগের ঝুঁকিও থাকে।

মানুষ অনেক কারণে মুটিয়ে যেতে পারে। কায়িক পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ, বংশপরম্পরায় জিনগত প্রভাব, কিছু ক্ষেত্রে জিনের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন, হরমোন গ্রন্থির গন্ডগোল, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও মানসিক অসুস্থতা থেকে মানুষ মোটা হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, খুব কম খেলেও ক্রমেই ওজন বেড়ে যায়। সাধারণত শহরাঞ্চলের মানুষ অতি স্থূলতা সমস্যায় বেশি ভুগে থাকে। তবে গ্রামেও সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। শুনে আশ্চর্য হবেন, এ দেশের বস্তিবাসীর মধ্যে খাবার নিয়ন্ত্রণের সচেতনতা না থাকায় সেখানেও স্থূলতায় ভুগছেন ৬ শতাংশ!

দেশের চিকিৎসকেরা এক সমীক্ষায় দেখেছেন, স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী উচ্চ রক্তচাপ কিংবা কিডনি রোগে ভুগে থাকেন। এ থেকে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অতিরিক্ত ওজন কিংবা মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যায় ভুগছেন।
বাংলাদেশে মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা সবচেয়ে প্রকট নারী ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে। বিশেষ করে বিবাহিত প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন স্থূলকায় বা অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় ভুগছেন। চার বছর আগে স্থূলতা নিয়ে দেশের প্রথম জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শহরাঞ্চলের ১৪ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার শিকার। রাজধানীতে এ হার ২১ শতাংশ। দুই বছর আগেও দেশের মহানগরগুলোতে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১৪ জনের ওজন বেশি ছিল এবং ৪ জন অতি স্থূলতায় আক্রান্ত। সেই সংখ্যাটা এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়ার কথা।

ওজন হুট করে একদিনে বাড়ে না। অনেকটা সতর্কসংকেত দিয়ে দিয়েই বাড়ে। আমরা মনোযোগ দিই না। ডেকে আনি নিজের বিপদ।

স্থূলতা বাড়ার কারণ
কেবল বেশি খাওয়া আর কায়িক পরিশ্রমের ঘাটতির জন্যই মানুষ মোটা হয় না। দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক বদঅভ্যাস রয়েছে যেগুলো ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও প্রকট। শহরাঞ্চলের শিশুদের খেলার মাঠের বড়ই অভাব। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শিশুদের প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে খেলতে হবে। বড়দের ক্ষেত্রে এ সমস্যার গভীরতা বোঝার জন্য আরও বেশি গবেষণার প্রয়োজন আছে। আসুন দেখে নিই অতি স্থূলতা বাড়ার কিছু কারণ:

১. অনেক সময় দেখা যায়, প্রচুর খেয়েও মোটা হয় না। আবার কম খেয়েও শরীরের ওজন বাড়ছে হু হু করে! এর কারণ ‘ওক জিন’। ফ্যাট সেলের মধ্যকার এ জিন লেপটিন হরমোন তৈরি করে থাকে। এ হরমোন মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে জানিয়ে দেয় দেহে চর্বির পরিমাণ। মস্তিষ্কে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রক সেল আছে। জিনগত ত্রুটির কারণে যদি লেপটিন হরমোন কম সংশ্লেষিত হয়, তাহলে দেহে ক্ষুধার পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ থাকে না, ফলে মানুষ মোটা হয়।

২. থাইরয়েড গ্রন্থি সঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরের শক্তি খরচের মাত্রা কমে যায়, তবে শক্তি সঞ্চয়ের মাত্রা একই থাকে। এতে ওজন বাড়ে, ফলে মানুষ মোটা হয়। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের (পিসিওএস) ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের প্রবাহ দ্রুত বেড়ে যায়, এতে ওজন বাড়ে।

৩. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও মানুষ স্থূলতায় আক্রান্ত হতে পারে। গর্ভনিরোধক ও দুশ্চিন্তা দূর করার ওষুধ, হাঁপানি ও একজিমা রোগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ‘স্টেরয়েড’ মানুষের ওজন বাড়ায়।

৪. ক্যালরি গ্রহণ ও খরচের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে মানুষ স্থূলতার শিকার হয়। যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করছেন, কিন্তু সে তুলনায় কায়িক পরিশ্রম করছেন না মানে ক্যালরি খরচ করছেন না—এতে আপনার শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমবে এবং স্থূলতায় আক্রান্ত হবেন। অনেকে বড় কামড়ে খাবার খান। খুব বেশি না চিবিয়ে দ্রুত গিলে ফেলেন। এতে স্বাভাবিকের তুলনায় শরীর বেশি পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করে।

৫. পর্যাপ্ত পানি পান না করা ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ। যাঁরা দিনে পরিমাণমতো পানি পান করেন না, তাঁরা অন্যদের তুলনায় দ্রুত মোটা হন। পানি শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সহায়তা করে। পরিমাণমতো পানি পান না করলে মাত্রাতিরিক্ত দূষিত পদার্থ জমে শরীর ফুলে যেতে পারে। এ ছাড়া সঠিক মাত্রায় বিশ্রামের অভাবেও স্থূলতায় আক্রান্ত হতে পারেন। ঘুমের মধ্যেও মানুষের শরীরের মেদ ঝরে, তাই কম ঘুমালেও মোটা হতে পারেন।

প্রতিরোধের উপায়
স্থূলতাকে রোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিরোধ করাই শ্রেয়। জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আবশ্যক। স্থূলতার বিপক্ষে লড়াইয়ের প্রথম ধাপ হতে পারে নিয়মিত ব্যায়াম আর পরিমিত খাবার গ্রহণ। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিরোধের কিছু উপায় জেনে রাখলে ফল পেতে পারেন।

খাবারে পরিবর্তন
স্বাস্থ্যকর খাবার খান। প্রতিদিনের খাবারে থাকুক ফলমূল, সবুজ শাকসবজি আর অপরিশোধিত শস্যজাত খাবার। মিষ্টান্ন, ভাজাপোড়া, ‘জাঙ্কফুড’, প্যাকেটজাত কিংবা পরিশোধিত খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রতিবেলায় খাবারের পরিমাণ কমাতে পারেন। খাবার ভালোমতো চিবিয়ে খেলে স্বাস্থ্যের জন্য ফলপ্রদ। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, কোনো ব্যক্তির শরীরে ৫ কেজির বেশি অতিরিক্ত ওজন থাকলে প্রতিদিন ৫০০ কিলোক্যালরি খাবার কম খেলে সপ্তাহে আধা কেজি ওজন কমবে, মাসে কমবে ২ কেজি। স্থূলতা কমানোর সাধারণ চারটি খাদ্যাভ্যাস হলো—কম চর্বি, কম কার্বোহাইড্রেট, কম ক্যালরি এবং খুবই কম ক্যালরির খাদ্যগ্রহণ। এ ক্ষেত্রে অ্যালকোহল পরিহার করুন। কারণ, অ্যালকোহলে প্রচুর চর্বিজাতীয় উপাদান থাকে।

শারীরিক পরিশ্রম
স্থূলতা কমাতে কায়িক শ্রম বা ব্যায়ামের বিকল্প নেই। চর্বি এবং গ্লাইকোজেন থেকে পাওয়া শক্তি ব্যবহার করে পেশি। এ ক্ষেত্রে পায়ের পেশি বড় হওয়ার কারণে হাঁটা, দৌড়ানো ও সাইকেল চালালে শরীরের ওজন কমবে। পেটের অতিরিক্ত মেদ ঝেড়ে ফেলতে নিয়মিত সাঁতার ভীষণ কার্যকরী। সাঁতারে পেটের অতিরিক্ত মেদ ঝরে সবচেয়ে বেশি। ‘কার্ডিভাসকুলার’ ব্যায়ামের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে আধা ঘণ্টা সময় বের করুন। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ব্যায়াম করা জরুরি। বাসায় বসে ‘দড়িলাফ’ মানে ‘স্কিপিং’ করেও অতিরিক্ত মেদ ছেঁটে ফেলতে পারেন।

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
খাবারের প্লেট ছোট আর গ্লাস বড় করুন। এতে খাবারের পরিমাণ কমবে এবং পানি খাওয়ার পরিমাণ বাড়বে। স্থূলতা কমাতে প্রচুর পানির প্রয়োজন। গ্লাস বড় হলে অজান্তেই সেটা আপনাকে সাহায্য করবে। খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান করুন। এতে পাকস্থলীর একটি অংশ ভরবে, ফলে আপনি এমনিতেই কম খাবার খাবেন। পরিসংখ্যান বলে, যাঁরা রাত জাগেন এবং গভীর রাতে খাওয়ার অভ্যাস আছে, তাঁদের ওজন বাকিদের তুলনায় বেশি বাড়ে। রাত জেগে থাকলে শরীর কিন্তু ক্যালরি পোড়াতে পারে না। তা ছাড়া রাত জাগলে স্বাভাবিকভাবেই খাবার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি হয়। এ জন্য ঘুমোনোর দুই ঘণ্টা আগে ও রাত ১০টার মধ্যে খেয়ে নেওয়া ভালো। যাঁরা দ্রুত খাবার খান, তাঁদের খাদ্যগ্রহণ অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাবার খান। এতে অল্প খাবারেই ক্ষুধা মিটবে। গল্প করতে করতে কিংবা টিভি দেখতে দেখতে খাবেন না। এতে অজান্তেই বেশি খেয়ে ফেলবেন।

চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
খাবার নিয়ন্ত্রণ কিংবা ব্যায়ামে কাজ না হলে দ্রুত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অতিরিক্ত মেদ ছেঁটে ফেলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে দুই ধরনের অতি স্থূলতা প্রতিরোধক ওষুধ অনুমোদন করেছে—ওরলিস্ট্যাট (জেনিক্যাল) ও সিবুট্রামাইন (মেরিডিয়া)। প্রথম ওষুধটি অগ্ন্যাশয়ের লিপাসকে বাধা দিয়ে অন্ত্রের চর্বি শুষে নেয়। পরেরটি কাজ করে মস্তিষ্কে। এতে খাবার গ্রহণের ইচ্ছা কমে যায়। তবে ওষুধ বা সার্জনের সাহায্য নিয়ে চর্বি কমানোর চেয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কমানোই ভালো। সেই পথও আপনাকে দেখাতে পারেন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদ।

শেষ কথা
অতিমাত্রায় স্থূলকায় হয়ে পড়লে নিজেকে ‘একঘরে’ ভাববেন না। বরং মন শক্ত করে নেমে পড়ুন লড়াইয়ে। মানুষের জীবনে ইচ্ছাশক্তির চেয়ে বড় কিছু নেই। সেই শক্তিকে পুঁজি করে বিধিমতো চেষ্টা করুন। স্থূলতার কোন পর্যায়ে আছেন, তা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন। কোনোভাবেই হতাশ হওয়া চলবে না। মনে রাখবেন, হতাশ হলেন তো আরেকটু মোটা হলেন!