পড়াশোনায় মন বসাতে পারছি না

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মেহতাব খানম
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন: আমি ২০ বছর বয়সী একটি মেয়ে। বড় ধরনের সমস্যায় ভুগছি বেশ কয়েক দিন ধরে। সামনে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। আমি কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছি না। অন্য কিছুতেও না। তিন-চার মাস যাবৎ পরপর খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার দুজন আত্মীয়ের মৃত্যু আমার ওপর খুব গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমার মনে মৃত্যুভয় দানা বাঁধতে বাঁধতে ক্রমশই বড় আকার ধারণ করেছে। যেকোনো সময় ঘুমাতে গেলে বা একটু অসুস্থ হলেই শরীর শিউরে ওঠে। এখনই বুঝি মারা যাব। তা ছাড়া শরীরও বেশ কয়েক দিন যাবৎ খারাপ থাকার কারণে মন ভেঙে গেছে। আজকাল আত্মবিশ্বাস ও মনোবল পুরো হারিয়ে বসে কেবল প্রতিদিন হতাশা আর বিষণ্নতায় ভুগছি। কিছু ভালো লাগে না আর জীবনের ওপর সব আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি এখন কী করব?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: তোমার যে বিষয়গুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, তা হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। গত প্রায় ১০ মাস আমরা সারা বিশ্বের মানুষ যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তা গত ১০০ বছরেও সমষ্টিগতভাবে কাউকে অনুভব করতে হয়নি। নিজেকে নিয়ে, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে এতটা দুশ্চিন্তায় আমাদের পড়তে হয়নি। এর মধ্যে কাছের মানুষদের হারানোর কষ্টেও পড়ে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। তুমিও অল্প সময়ের মধ্যে দুজন আত্মীয়কে হারিয়েছ। এত কিছুর মধ্যে থেকে পড়ায় মন বসাতে না পারাটা খুব স্বাভাবিক হলেও তোমার মন সেটি মানতে চাইছে না।

এসব বিষয় তোমাকে আগামী দিনগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। ঘরবন্দী জীবনে থেকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ঠিকমতো করতে পারছ না বলে ভীষণ মানসিক চাপে পড়ে যাচ্ছ তুমি। তবে যে বিষয়টি নিয়ে তুমি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছ তা হচ্ছে, ঘুমাতে গেলে বা অসুস্থ লাগলেই ‘মারা যাব’ কথাটি মনে হওয়া।

মনে হয় তোমার ‘প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে, যা সত্যিই খুব কষ্টকর। যদিও আজ পর্যন্ত এই ধরনের উপসর্গ হওয়ার পরও কেউ মারা যায়নি, তারপরও এটি নিয়ে পথচলা বেশ কঠিন।

কোভিড শুরুর পর তোমার বয়সের কাছাকাছি কেউ কেউ এই ধরনের উপসর্গের কথা বলছে। দেখা যায়, যারা শৈশব ও কৈশোরে খুব একটা ইতিবাচক পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ পায়নি, আশপাশের মানুষেরা তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করেনি, তারা এই অসুবিধার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। জীবনধারাও তাদের স্বাভাবিকভাবে চলছে না, কারও মানসিক অসুস্থতাও বেড়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে সন্তানেরা যখন অভিভাবকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না, তাঁরা হতাশাব্যঞ্জক কথাবার্তা বলার ফলে সন্তানদের ভেতরের ভয় আরও ঘনীভূত হচ্ছে। আমার সুপারিশ হচ্ছে, তুমি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করো আর দেরি না করে। প্রচণ্ড মনের চাপ তোমার শরীরকেও অসুস্থ করে তুলছে এবং দুশ্চিন্তার নামে বিষণ্নতা তৈরি হওয়ায় আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি হচ্ছে।

তুমি একজন মনোচিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করো। এর পাশাপাশি সাইকোথেরাপি নিতে থাকো। থেরাপিস্ট তোমাকে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অতীতের কষ্টগুলোকে মোকাবিলা করতে সহায়তা করবেন। অনেক ধরনের ধ্যান (মেডিটেশন), রিলাক্সেশনের ব্যায়াম রয়েছে, যা করতে তোমাকে সুন্দরভাবে শিখিয়ে দেবেন। তুমি বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ০৮০০০৮৮৮০০০ (টোল ফ্রি) এই টেলিসেবা নম্বরে ফোন করে কাউন্সেলিং নিতে পারো। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকেও সেবা নিতে পারো।

এটুকু বয়সে কেন তুমি জীবনের আশা ছেড়ে দেবে? চিকিৎসা নিলে তুমি অবশ্যই অনেক আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।

লেখা পাঠানোর ঠিকানা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো

প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA