ফিজিওথেরাপি পেশার ইতিহাস

কোলাজ: রজত কান্তি রায়

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ বর্ষের দিকে প্রথমে হিপোক্রেটিস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০–৩৭০) এবং পরবর্তী সময়ে গেইলিয়াস বিভিন্ন সফট টিস্যু মোবিলাইজেশান, ম্যানুয়াল থেরাপি টেকনিক, হাইড্রোথেরাপি প্রভৃতির মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সূচনা করেন। ধীরে ধীরে অর্থোপেডিক কন্ডিশন সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকলে ১৮ শতাব্দীর দিকে জয়েন্টের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন রকম এক্সারসাইজ প্রোগ্রাম শুরু করা হয়।

হিপোক্রেটিস
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার জনক পের হেনরিক লিং (১৭৭৬–১৮৩৯) যাকে ‘ফাদার অব সুইডিশ জিমন্যাস্টিক’ও বলা হয়ে থাকে, ১৮১৩ সালে রয়্যাল সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব জিমন্যাস্টিক স্থাপন করেন, যেখানে সফট টিস্যু মোবিলাইজেশন, ম্যানিপুলেশন এবং এক্সারসাইজের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করা হয়। সুইডেনের ন্যাশনাল বোর্ড অব হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ১৮৮৭ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের অফিশিয়াল রেজিস্ট্রেশন শুরু করে। উন্নত দেশগুলোও তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। যেমন গ্রেট ব্রিটেনে ১৮৯৪ সালে চার্টার্ড সোসাইটি অব ফিজিক্যাল থেরাপি গঠিত হয়। ১৯১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোতে দ্য স্কুল অব ফিজিওথেরাপি চালু করা হয়।

১৯১৪ সালে রিট কলেজ আমেরিকাতে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। বিশ্ব উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং ১৯৮০-এর দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও গবেষণার অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়। সমগ্র বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় উন্নয়নের নজির রয়েছে।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার জনক পের হেনরিক লিং
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

সারা বিশ্বে স্পোর্টস মেডিসিনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা প্রথম কন্টাক্ট চিকিৎসক, অন্যান্য বিশেষায়িত শাখা, যেমন স্পাইনাল ডিসফাংশন, মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিসফাংশন, কার্ডিওভাস্কুলার অ্যান্ড চেস্ট ডিজিজেস, নিউরোলজি এবং নিউরো সার্জারি, শিশুরোগ, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, অর্থোপেডিক মেডিসিন এবং অর্থোপেডিক সার্জারি ছাড়াও অন্যান্য শাখায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা সুনাম ও সফলতার সঙ্গে চিকিৎসা করছেন। বিশেষ করে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সার্বক্ষণিক দরকার, তা প্রমাণিত। সুতরাং এই পেশাজীবন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশ পর্ব

বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসার লক্ষ্যে ফিরোজা বারি হাসপাতালে প্রথম ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতালে (নিটোর) ১৯৭২-৭৩ সালে প্রথম ফিজিওথেরাপির ওপর স্নাতক শিক্ষা চালু হয়। ২টি ব্যাচ স্নাতক সম্পন্ন করার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর স্নাতক কোর্সটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতালে (নিটোর) ১৯৭২-৭৩ সালে প্রথম ফিজিওথেরাপির ওপর স্নাতক শিক্ষা চালু হয়। ২টি ব্যাচ স্নাতক সম্পন্ন করার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর স্নাতক কোর্সটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধীনে ফিজিওথেরাপির স্নাতক কোর্সটি আবার জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতালে (নিটোর) শুরু হয় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে একই অনুষদের অধীনে বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশন্স ইনস্টিটিউটে (বিএইচপিআই) কোর্স শুরু হয়। এরপর স্নাতক কোর্সটি পিপলস ইউনিভার্সিটি, গণ বিশ্ববিদ্যালয় (জিবি), স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্স, সাইক ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স, ঢাকা ও রাজশাহী আইএইচটিতে চালু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি কোর্স চালু হয়।

পাস করা ফিজিওথেরাপির চিকিৎসকেরা তাঁদের পেশাগত অনুশীলন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলেন, ইতিমধ্যে পেশার স্বকীয়তা হুমকির মুখে পড়েছে এবং ফিজিওথেরাপির শিক্ষার মান বজায় রাখা আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া কোনো স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ, ধারাবাহিকভাবে পেশাদার বিকাশের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা ছিল না। পেশাগত যোগ্য চিকিৎসকেরা নতুন পেশা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে কাজের সুযোগ বা অনুশীলনের সুযোগ পাননি। এমনকি অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারেরাও রোগীকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের কাছে রেফার করেন না।

১৯৯৬ সালে ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি ৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিপিএ ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিস্বরূপ গঠিত হয়েছে। বিপিএ ২০০৭ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের বৈশ্বিক সংগঠন বিশ্ব ফিজিওথেরাপি সংস্থার পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করে। বিপিএ ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসেছে।

এসব প্রতিকূলতা উত্তরণের জন্য সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। ১৯৯৬ সালে ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি ৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিপিএ ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিস্বরূপ গঠিত হয়েছে। বিপিএ ২০০৭ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের বৈশ্বিক সংগঠন বিশ্ব ফিজিওথেরাপি সংস্থার পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করে। বিপিএ ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসেছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন’ মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে এবং এই আইনের মাধ্যমে রিহ্যাবিলিটেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি, রিহ্যাবিলিটেশন সেবা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবীর নিবন্ধন ও সেবার মান নির্ধারণ ও নিশ্চিত করণের উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণীত হয়েছে।

চলতি বছর বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির ২৪তম বর্ষ পালিত হচ্ছে। বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কোভিড-১৯-পরবর্তী পুনর্বাসন চিকিৎসা এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের মুখ্য ভূমিকা’। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে কীভাবে একজন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করতে পারেন, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা দিকনির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করবেন। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ রোগে গুরুতর আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে পরিত্রাণ পেতে পুনর্বাসন এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা অত্যন্ত প্রয়োজন।

বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কোভিড-১৯-পরবর্তী পুনর্বাসন চিকিৎসা এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের মুখ্য ভূমিকা’। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে কীভাবে একজন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করতে পারেন, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা দিকনির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করবেন।

এ অবস্থায় রোগীরা বাইরে আসতে না পারলেও টেলিফোনের মাধ্যমে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন (www.bpa-bd.org) এবং শারীরিক কর্মক্ষমতার উন্নতি করতে টেলিফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ প্রচলিত স্বাস্থ্যসেবার মতোই কার্যকর পদ্ধতি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফিজিওথেরাপি বিভাগ, এম এইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ; চেয়ারম্যান, এসপি হাসপাতাল লি.; সভাপতি, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)