বাবা–মায়ের ঝগড়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত

পাঠকের কাছ থেকে সন্তান পালন, মনোজগৎ ও ব্যক্তিজীবনের সমস্যা নিয়ে পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মেহতাব খানমছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন: আমার মা–বাবার মধ্যে প্রতিনিয়ত ঝগড়া লেগেই আছে। তাঁরা যেকোনো ছোটখাটো বিষয় নিয়েও চিৎকার–চেঁচামেচি করেন। এরপর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কিছুক্ষণ পরই মা সব বাদ দিয়ে আবার বাবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু বাবা তা করেন না। বাবা আমাদের কিছু না বলে বাসা থেকে চলে যান। কিছুদিন পর আবার চলে আসেন। মানুষ হিসেবে একজনকে যে সম্মানটুকু দেওয়া দরকার, মা সরকারি চাকুরিজীবী হওয়া সত্ত্বেও তা পান না বাবার কাছ থেকে। সব সময়ই মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এসব দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। পড়াশোনায় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছি না। আমি তাই এখন হোস্টেলে থাকি।

করোনার সময়ে বাসায় থাকায় প্রতিনিয়ত আমাকে মা–বাবার ঝগড়ার সম্মুখীন হতে হয়। যেকোনো সাধারণ ব্যাপারে বাবা কুৎসিত ভাষায় মাকে গালাগাল দেন। তাঁদের এই আচরণ আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। কী করব?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ঢাকা

উত্তর: সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন মা–বাবার মধ্যে বোঝাপড়া, হৃদ্যতা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পরিবর্তে ঘৃণা, অসম্মান, ক্ষমতা প্রয়োগ ও অবিশ্বাসের চর্চা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। সন্তানেরা বয়সে ছোট থাকে বলে মা–বাবার অসুস্থ আচরণগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে তেমন কিছু করতে পারে না। যাঁদের তারা ভালোবাসে এবং সম্মান করতে চায়, তাঁরা যখন নিজেরাই পরস্পরের প্রতি সহিংস আচরণ করেন, তখন সেই পরিবেশে সন্তানদের বুকভরে নিশ্বাস নিতেও অসুবিধা হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড অসহায়ত্ব, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। তারা বিরক্তি ও রাগ ভেতরে চেপে রেখে মাঝেমধ্যে খুব অবাক হয়ে লক্ষ করে, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কীভাবে একেবারে অবুঝ শিশুর মতো আচরণ করছেন।

আমার সাইকোথেরাপি সহায়তা দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলব, সন্তানেরা বেশির ভাগ সময় মাকেই বেশি কষ্ট পেতে দেখে। এ অবস্থা দেখতে দেখতে ছেলেশিশুটি যখন একটু বুঝতে শেখে, তখন তার অবচেতন মনের সিদ্ধান্ত হতে পারে যে মেয়েরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়। আবার আমি এটিও শুনি যে ছেলে শিশুটি মনে মনে কল্পনা করে, সে অনেক বড় হয়ে মাকে এই দুর্বিষহ পরিবেশ থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে।

এমন পরিবেশে বড় হওয়ার সময় মেয়েশিশুর ভেতরে এই বিশ্বাস তৈরি হতে পারে, সে কখনো কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করবে না কিংবা সে নিজেকে পুরুষের তুলনায় কম যোগ্য মনে করে নিজেকেও অবচেতনভাবে অশ্রদ্ধা করতে শুরু করতে পারে। তার মনে ভয় কাজ করে যে বিয়ের পর হয়তো তারও পরিণতি এ রকমই হবে।

যদি মা তাঁর অপরিণত বয়সের কন্যাসন্তানের সঙ্গে তাঁর দুঃখ–দুর্দশার কথা আলোচনা করেন, তাহলে মায়ের কষ্টের সঙ্গে সে-ও একাত্ম হয়ে যায়। অনেক সময় মায়ের প্রতি তার একধরনের রাগ এবং অশ্রদ্ধাও কাজ করে এই ভেবে, মা কেন এই অপমানজনক, দুর্বিষহ জীবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের জীবন গড়ে নিচ্ছেন না।

একজন মেয়ে সন্তান হিসেবে মা–বাবার এই অশান্তির মধ্যে থেকে বড় হওয়ার সময় তুমিও যে এ ধরনের মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে দিন পার করছ, তা বুঝতে পারছি। মা যখন বাবার কাছ থেকে এত দুর্ব্যবহার পাওয়ার পরও নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন, তখন সেটি তোমার মধ্যে প্রচণ্ড মনঃকষ্ট তৈরি করছে। বাবার
কুৎসিত ভাষার চর্চা হয়তো তোমার মধ্যে
রাগ ও বিদ্বেষ তৈরি করছে। এ ছাড়া বাবার এভাবে বাসা থেকে চলে যাওয়া তাঁর দায়িত্বজ্ঞানের অভাব এবং মানসিক অপরিপক্বতাও নির্দেশ করে।

করোনা মহামারির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দিন ধরে বন্ধ থাকা এবং সামনে আরও অনিশ্চয়তা থাকার জন্য তুমি নিশ্চয়ই অনেক দুশ্চিন্তায় ভুগছ। এর মধ্যে হোস্টেল ছেড়ে সারাক্ষণ বাসায় থাকতে হচ্ছে বলে তোমার ভেতরে আরও নেতিবাচক আবেগ তৈরি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। মানসিক এ পরিস্থিতি থেকে কিছুটা উত্তরণের জন্য তুমি ভাবতে পার, তাঁরা তো তাঁদের অভ্যাসগত আচরণ থেকে কখনো বের হচ্ছেন না। তাই যতটা সম্ভব তাঁদের পারস্পরিক আচরণগুলোকে গুরুত্ব কম দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোর একটি কাঠামো দাঁড় করাতে হবে।

তুমি নিজের জন্য একটি আলাদা গণ্ডি তৈরি করে সেখানে সচেতনভাবে সুস্থ চিন্তার অনুশীলন করতে পার। আমি জানি, কথাগুলো যত সহজে বলছি, তোমার জন্য কাজটি করা তত সহজ হবে না। তবে যেহেতু তুমি এখনো স্বনির্ভর হওনি, তোমাকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরও কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তোমার ভেতরে যে সত্তাটি কষ্ট পাচ্ছে, তাকে মনে মনে বল, তুমি কোনো দিনও তাকে একটুও অশ্রদ্ধা করবে না। কল্পনায় ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে ওকে ভালোবেসে সারাক্ষণ উৎসাহ দাও। এখন তোমার অনেক ক্লান্ত ও অসহায় লাগছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে তুমি মনের এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে।

সারা দিনের মধ্যে কিছুটা সময় নিজের জন্য আলাদা করে রেখো তোমার মন আর শরীরের যত্ন নেওয়ার জন্য। প্রতিনিয়ত ধ্যান, শরীরচর্চা, ভালো বই পড়ার মাধ্যমে নিজেকে কিছুটা হলেও উজ্জীবিত রাখো। তুমি যদি এখন থেকেই নিজের প্রতি যত্নশীল হয়ে ভবিষ্যতের দিনগুলোকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পার, তাহলে মা-বাবার যখন তোমার প্রয়োজন হবে, তখন তুমি তাঁদের প্রতিও যত্নশীল হতে পারবে।

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে চিঠি পাঠানোর ঠিকানা—

অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

ই-মেইল: [email protected]

ফেসবুক: facebook.com/adhuna.PA

খামের ওপর ও ই-মেইলের subject–এ লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’