যেভাবে ২৭ কেজি ওজন কমালেন হাসিন

মডেল ও অভিনেত্রী হাসিন রওশনের ডায়েটের আগে ও পরের দুটি ছবিগ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

২০১৭ সালে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর হাসিনের ওজন বাড়তে থাকে। তাঁর ভাষায় ‘অস্বাভাবিকভাবে’। কারণ, সে সময় তাঁর ওজন বেড়েছিল ২৫ কেজিরও বেশি। সেটা কমাতে নানা রকম পরামর্শ মেনেছেন, তবে কাজ হয়নি। তিন বছর পর ছয় মাসের এক বিশেষ মিশন মানে ডায়েট করে ২৭ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেন মডেল ও অভিনেত্রী হাসিন রওশন জাহান। কীভাবে সেই অসম্ভবকে সম্ভবকে করেছেন, সেই গল্পই বলেছেন তিনি।

২০১১ সালে ‘ভিট-চ্যানেল আই টপ মডেল’ প্রতিযোগিতার খেতাব জিতে কাজ শুরু করেন হাসিন। নাটক, বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশন মডেল হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। বিয়ের পর (২০১৬) হঠাৎ বিনোদনজগৎ ছেড়ে দেন। পরের বছর ছেলে উজায়ের মাঈনের জন্মের পর তিনি বুঝতে পারেন তাঁর ওজন যতটা বেড়েছে, সেটা স্বাভাবিক না। হাসিন বলেন, ‘প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ডাক্তার কখনো বলেননি যে আমার ওজন এভাবে বাড়ানো ঠিক হচ্ছে কি না। মা হওয়ার পর সবারই ওজন বাড়ে, তবে এই পরিমাণ বাড়াটা যে স্বাভাবিক না সেটা বুঝতে পারি সন্তান হওয়ার পর।’

লাখ টাকার ব্যর্থ মিশন

ওজন ঝরিয়ে ফুরফুরে হাসিন (বাঁয়ে), বাড়তি ওজন নিয়ে চলাচলেও সমস্যা হতো (ডানে)
গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

মা হওয়ার পর অনেকেই কয়েক মাসের মধ্যেই ফিট হয়ে যান, বিশেষ করে তারকারা। পুষ্টিবিদ নাহিদা আক্তার জানান, ‘অন্তঃসত্ত্বা সব মায়েরই ওজন বাড়ে। কারও ওজন যদি উচ্চতা অনুযায়ী ঠিক থাকে তবে তাঁর ১০-১২ কেজির বেশি বাড়ানো উচিত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করে দেওয়া ওজন এটা।’

তবে হাসিনের ওজন তারও দুই গুণ বেশি বেড়ে যাওয়ায় তিনি চিন্তায় পড়েন। হাসিন বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকেই নিজের বাড়তি ওজন কমানোর জন্য নানা চেষ্টা চালাতে থাকি। পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে কয়েক মাস চেষ্টা করেছি, তবে সেটা খুবই ধীরগতির হওয়ায় হতাশ হয়ে ছেড়ে দিই।’

মাঝেমধ্যেই বিদেশে বেড়াতে যান হাসিন। সে সময় একবার বোনের কাছে লন্ডনে বেড়াতে গিয়ে দুই মাস একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিনের বিশেষ খাবার নিয়ে খেয়েছেন। ডায়েট চার্ট অনুসারে খাবার সরবরাহ করায় তাদের সুনাম পুরো ইংল্যান্ডে। সেই কিটো ডায়েটের জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে গ্রাহকের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিত। লাখ টাকা খরচ করেও সেবার ওজন কমাতে পারেননি হাসিন। নানা রকম ব্যায়ামও করেছেন। এরপর আরও কয়েক দফা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়েছেন তবে কোনোবারই ধৈর্য রাখতে পারেননি। এর কারণও আছে। হাসিন রওশন বলেন, ‘আমি ভাতপাগল এক মানুষ। প্রতিদিন ভাত না খেলে আমার ভালো লাগে না। হানিমুনে লাঙ্কাউই (মালয়েশিয়া) গিয়ে ভাত বা ফ্রায়েড রাইস না পেয়ে দুই দিন পরই ফিরে এসেছিলাম কুয়ালালামপুর। সেই আমি ভাতই ছাড়লাম, ওজন কমানোর জন্য।’

মিশন লকডাউন

ওজন কমানোর পর ছেলের সঙ্গে হাসিন
ছবি: সংগৃহীত

দুই বছর চেষ্টা করেও যখন ওজন কমল না, হাসিনের তখন উৎসাহ এসে তলানিতে ঠেকেছে। ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে সবাই ঘরে ঢুকে গেল। এমন সময় ইউটিউবের একটি ভিডিও দেখে আবার প্রেরণা পেলেন হাসিন। একসময় টেলিভিশনের এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী বলেন, ‘আমি মূলত ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের কয়েকটি ভিডিও দেখে আবার ওজন কমাতে উৎসাহ পাই। তিনি বিষয়টা খুব সহজ করে দিয়েছিলেন আমার জন্য। তাঁর পরামর্শ মেনেই আবার নতুন খাদ্যাভ্যাসে ফিরি।’

লকডাউনে বাসায় বিশেষ কোনো কাজ ছিল না। তাই মার্চের শেষ দিকে ডায়েটের সঙ্গে শরীরচর্চায় মন দেন। ভাতপাগল এক মা নেমে পড়লেন ‘নো কার্ব’ ডায়েটে। তবে প্রথম দিন থেকেই ভাত ছাড়েননি হাসিন, অভ্যাস করেছেন ধীরে ধীরে।

কী ছিল সেই ডায়েটে

রোজা রেখে ইফতারিতে খেতেন এমন খাবার

হাসিন রওশন বলেন, ‘ইউটিউবে ডাক্তারের সেই পরামর্শ আমি যে শতভাগ মেনে চলেছি, তা না। কিছুটা ফাঁকিও দিয়েছি। প্রথমে দুই বেলা ভাত খাওয়ার অভ্যাস কমিয়ে এক বেলায় আনি। দুপুরে তখন ভাত খেতাম আর রাতে একটা রুটি। বাদ দিয়েছিলাম মিষ্টি খাওয়া। ৮-৯ দিন পর এক বেলার ভাতও বাদ দিলাম। কারণ, তখন মনে হয়েছে আমি ভাত ছাড়া থাকতে পারব। ওজন কমাতে মনের জোর সবচেয়ে জরুরি।’

দেখে নিন হাসিনের তিন বেলার খাবারের তালিকা:

সকাল: মাখনে ভাজা ২টা ডিম, এমসিটি (মিডিয়াম-চেইন ট্রাইগ্লিসিরাইডস) তেলসহ এক মগ কালো কফি আর পর্যাপ্ত পানি।

দুপুর: ১টা ডাবের পানি, স্যুপ ১ বাটি, ১টা ডিম সেদ্ধ ও ১টা শসা। স্যুপের স্বাদে ভিন্নতা আনতে কখনো টমেটো সস, কখনো মুরগি, আবার মাশরুম বা কলি (একধরনের সবজি) ফ্লাওয়ার ব্যবহার করতেন।

বিকেল: মাখনে ভাজা বাদাম (চিনা বা কাজু) ও এমসিটি অয়েল দিয়ে এক মগ ব্ল্যাক কফি।

রাত: পাঁচমিশালি সবজি, মাছ বা মাংস, শাক এবং মাঝেমধ্যে টক দই।

এসবের বাইরে প্রতিদিন কমপক্ষে তিন লিটার পানি পান করেছেন হাসিন। দিনে ২ বেলা ২০ মিনিট করে হেঁটেছেন ঘরের মধ্যে, ছাদে আর বাসার নিচে।

এই রুটিনে ১৫ দিন চলার পর আবার একটা পরিবর্তন অনেন খাবারে। সকালের নাশতা বাদ দিয়ে দেন তালিকা থেকে। কোনো কোনো দিন সকালে একটা ডিম খেয়েছেন শুধু। এরপর একবারে বিকেল তিনটা-চারটার দিকে খেয়েছেন। এভাবে চলতে চলতে এসে গেল পবিত্র রমজান মাস। হাসিন আবার খাবারের অভ্যাস পাল্টে নিলেন। ইফতারে খেতেন দুপুরের খাবার আর সাহ্‌রিতে ডিম, শসা কখনো সালাদ।

ছয় মাসে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে

ওজন কমানোর পর

মার্চ মাসে শুরু করা এই নতুন জীবনধারায় হাসিন টানা ছয় মাস চলেছেন। ৮০ কেজি থেকে তত দিনে নিজের ওজন নামিয়ে এনেছেন ৫৩ কেজিতে। এরপর আবার খাবার তালিকায় অল্প অল্প কার্ব যুক্ত করতে থাকেন। ফিরতে শুরু করেন স্বাভাবিক অভ্যাসে। তবে ছয় মাস ভাত আর চিনি না খাওয়ার কারণে ভাতের প্রতি টান কমে গেছে।

গত বছর অক্টোবর মাসের আগেই ওজন নিয়ন্ত্রণ আনার পর ডায়েটও ছেড়েছেন। ফেসবুকে সেই খবরও জানিয়েছেন সম্প্রতি। হাসিন বলেন, ‘আমি আসলে ওজন ঠিক রাখা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। একই সঙ্গে যেহেতু ইউটিউবের ভিডিও দেখে ওজন কমিয়েছি তাই নিজের কোনো সমস্যা হয় কি না, সেটা যাচাই করলাম। আট মাস পর যখন মনে হলো আমার বিশেষ কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, তখন বিষয়টা সামনে আনলাম।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২৭ কেজি ওজন কমানোর বিষয়টি জানানোর পর থেকে হাজার হাজার এসএমএস পাচ্ছেন মানুষের। বেশির ভাগের প্রশ্ন কীভাবে কমল এত ওজন? জনে জনে সবাইকে উত্তর দেওয়া কঠিন। সপ্তাহখানেক আগে তাই ফেসবুকে একটি প্রাইভেট গ্রুপ খুলেছেন “হাসিন’স টেল” নামে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ওজন কমাতে গিয়ে অনেকের নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ভুল ডায়েট করে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। হাসিনের কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল? তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘বড় কোনো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হইনি।’ এরপর যুক্ত করলেন, ‘তবে ডায়েট করার পর আমার অনেক চুল ঝরে গিয়েছিল আবার ত্বকও খারাপ হয়ে পড়েছিল। বিষয়টির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। কারণ, ভিডিওতে সে বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তবে ডায়েট পর্ব শেষ হওয়ার পর দেখলাম আমার চুল আগের চেয়ে বেশি গজিয়েছে। ত্বকও স্বাভাবিক হয়ে আসে কিছুদিনের মধ্যে।’

অনেকের ডায়েট শুরু করার পরপর মাথা ঘোরার মতো সমস্যা হতে পারে, সেটাও স্বাভাবিক বলে মনে করেন হাসিন।

ওজন কমাতে সবচেয়ে জরুরি কী, জানতে চাইলে হাসিন বলেন, ‘মনের জোর। বারবার আমি হোঁচট খেয়েছি মনের জোর না থাকার কারণে। আমি যদি মনে করি আমি পারব, তাহলেই কেবল পারা যায়।’

তবে নিজের ওজন বাড়তে শুরু করার পরই যদি লাগাম টেনে ধরা যায়, তাহলে ভালো। আর এই লাগাম ধরতে থাকা চাই মনের জোর। হোক সে তারকা বা সাধারণ কেউ।