শরীরের ঘুণপোকা অস্টিওপোরোসিস

ডা. তানিয়া আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব, অর্থোপেডিক ও স্পাইন সার্জন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম

অস্টিওপোরোসিস। হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। এই রোগকে চিকিৎসকেরা নীরব ঘাতক হিসেবে অভিহিত করেন। কারণ, খুব নীরবে এটি মানুষের শরীরের হাড়গুলোকে ভঙ্গুর করে দেয় এবং হাড়ের ব্যাপক ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত এর তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তাই প্রয়োজন পূর্বসতর্কতা।

মানুষকে অস্টিওপোরোসিস বিষয়ে সচেতন করতে ২০ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘এসকেএফ অস্টিওপোরোসিস দিবস’। অনুষ্ঠানটির প্রথম পর্বের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অস্টিওপোরোসিস কী এবং চিকিৎসা’।
চিকিৎসক তানিয়া আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব, অর্থোপেডিক ও স্পাইন সার্জন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানটি ১৯ অক্টোবর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম অস্টিওপোরোসিস বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানান, অস্টিও মানে হাড়। পোরোসিস হলো ছিদ্র ছিদ্র হয়ে যাওয়া। এ রোগে হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় হালকা ও ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সাধারণভাবে বোঝাতে চাইলে একটি উদাহরণ দিতে হবে। কাঠে যেমন ঘুণ ধরে, অস্টিওপোরোসিসও হাড়ের জন্য ঘুণ। এটি হাড়কে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়। প্রতিবছর বিশ্বে ৯০ লাখের বেশি মানুষের হাড় ভাঙে অস্টিওপোরোসিসের কারণে।

সাধারণ অবস্থায় আমাদের শরীরে সব সময় নতুন টিস্যু তৈরি হতে থাকে, যা পুরোনো বা ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুকে সরিয়ে সেই জায়গাকে অক্ষত আর ঠিক রাখে। যে কারণে আমাদের শরীরের কাঠামো ঠিক থাকে। ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই নতুন টিস্যু তৈরির কাজ চলতে থাকে। এরপর থেকেই কমতে থাকে। ৪০ বছর বা তারপর থেকে এই টিস্যু তৈরি অনেক কমে যায়। ফলে কোনো হাড়ের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজন মতো টিস্যুর জোগান শরীর না–ও দিতে পারে। এভাবে একসময় অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সাধারণত এই রোগ পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি ও মেনোপজ–পরবর্তী নারীদের বেশি হয়।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে ৫০ বছরের অধিক বয়সের প্রতি ৩ জন মহিলার মধ্যে ১ জন এবং প্রতি ৫ জন পুরুষের ১ জন অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া যাদের আগে হাড় ভাঙার ইতিহাস আছে, দীর্ঘদিন স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ অথবা খিঁচুনির ওষুধ সেবন করেছেন, অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান, কম ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন, কায়িক শ্রমের ঘাটতি রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের এ রোগের ঝুঁকি বেশ। তা ছাড়া কিছু বাতজনিত রোগ, থাইরয়েড ও প্রজননগ্রন্থির রোগ, খাদ্যনালি থেকে পুষ্টি ও ভিটামিন শোষণে সমস্যা ইত্যাদি কারণেও অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।

অস্টিওপোরোসিস উপসর্গ সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম বলেন, সাধারণত হাড় ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত অস্টিওপোরোসিসের কোনো উপসর্গ থাকে না। পুরুষ ও মহিলা—উভয়কেই সাবধান থাকতে হবে এ ব্যাপারে। তবে নারীদের বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। বিশেষ করে মেনোপজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। কারণ, এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইস্ট্রোজেনের ঘাটতি থেকে অনেক সময় মহিলারা এ রোগের শিকার হন। সাধারণত এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো হচ্ছে কোমর, কোমরের নিচে, কবজি, হাঁটু ও শিরদাঁড়া।

তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাথার সমান উচ্চতা থেকে পড়ে হালকা আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। আবার হাড় ভেঙে গেলে ব্যথা ও হাড়ে বাঁক তৈরি হয়। কুঁচকির হাড় ভেঙে গেলে রোগী পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না এবং আক্রান্ত পা অন্য পায়ের চেয়ে কিছুটা খাটো হয়ে যায়। মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙলে পিঠে বা কোমরে ব্যথা হয় এবং রোগী সামনে কিছুটা কুঁজো হয়ে যায়।

এ রোগে হাতের কবজিও ভাঙতে পারে। এটি নির্ণয়ে কিছু রেগুলার চেকআপ প্রয়োজন। যেমন চিকিৎসক আপনার শারীরিক বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল উপসর্গ পর্যবেক্ষণ এবং পূর্ববর্তী রোগ ও ওষুধ গ্রহণের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ করে আপনার অস্টিওপোরোসিস আছে কি না, তা নির্ণয় করতে পারেন। এক্স–রের মাধ্যমেও হাড়ের ঘনত্ব বোঝা যায়। বিএমডি (বোন মিনারেল ডেনসিটি) বা হাড়ের ঘনত্ব নির্ণয় পরীক্ষার মাধ্যমেও জানা যায়।