সিসা দূষণে বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি শিশু আক্রান্ত

ছবি: প্রথম আলো

এ তথ্য ভয়াবহ সন্দেহ নেই। কারণ বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি শিশু অতিমাত্রায় সিসায় আক্রান্ত। ১৯ বছর বয়সের নিচে এই শিশুরা বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা সিসায় বেশি আক্রান্তের কারণ তাদের রক্তে চার–পাঁচ গুণ বেশি সিসা শোষিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিশুরা রয়েছে অধিক ঝুঁকিতে।

গত বছরের ৩০ জুলাই লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান বিশ্বব্যাপী অতিমাত্রায় সিসায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। পৃথিবীতে ৮০ কোটি, অর্থাৎ প্রতি ৩টি শিশুর মধ্যে একটি শিশুর রক্তে ৫ মাইক্রোগ্রাম/ডিএল অথবা এর বেশি মাত্রায় সিসা রয়েছে। ১৯ বছর বয়সের নিচে এই শিশুরা বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় শিশুরা সিসায় বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ, শিশুদের রক্তে চার–পাঁচ গুণ বেশি সিসা শোষিত হয়ে থাকে। ২০১৯ সালে যেখানে মরণব্যাধি ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষের, সেখানে সিসা দূষণের কারণে অকাল মৃত্যু হয়েছে ৯ লাখ মানুষের। ১৯৯০ সাল থেকে সিসা দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে ২১ শতাংশ। নির্দ্বিধায় বলা চলে, ভয়াবহ অবস্থা।

ছবি: প্রথম আলো

ইউনিসেফসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মানুষ সাধারণত পেশাগত ও পরিবেশগত কারণে সিসা দূষণের শিকার হয়। বহু দশক থেকে সিসাযুক্ত ফসিল জ্বালানি ব্যবহার, সিসা মেশানো রং আর পানির পাইপে সিসার অস্তিত্ব আজকের এ দুরবস্থার কারণ। এর সঙ্গে আছে জনস্বাস্থ্য প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে তৈরি করা সিসাযুক্ত প্রসাধনী এবং ওষুধের ব্যবহার। ভারত, মেক্সিকো ও ভিয়েতনামের মতো দেশে হাতুড়ে চিকিৎসকদের দ্বারা বানানো কিছু প্রচলিত ওষুধে সিসা মেশানো হয়। সিসা দূষণে দূষিত বাতাস, পানি, মাটি, খাদ্য, পানীয় সম্পর্কে সতর্ক না হওয়ায় ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকেরা।

পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ছবি: প্রথম আলো

ফ্রান্সের একটি অন্যতম বিজ্ঞান পত্রিকায় বিষাক্ত সিসা দূষণের ওপর তথ্যনির্ভর একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম। হঠাৎ চোখ স্থির হলো ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির ওপর। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, যেখানে মেক্সিকো ও ঘানার মতো দেশে সিসায় আক্রান্ত শিশুদের রক্তে ৫ মাইক্রোগ্রাম/ডিএল, সেখানে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৫৫ লাখের বেশি শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রার, অর্থাৎ ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ডিএলের বেশি সিসা রয়েছে। অর্থাৎ এই শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আর কালক্ষেপণের উপায় নেই, জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

ছবি: প্রথম আলো

সিসার বিষক্রিয়ার কারণে বিশ্বে যেসব দেশে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, সেসব দেশের মধ্যে বাংলদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলদেশে প্রায় ১ হাজার ১০০টি অননুমোদিত স্থানে কোনো রকম সুরক্ষা কিংবা সতর্কতা ছাড়াই মোটরগাড়িতে ব্যবহৃত পুরোনো সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইকেলিং করা এবং সে কারণে সিসা গলানো হয়। ফলে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়।

তা ছাড়া জনস্বাস্থ্যের জন্য তা বিপজ্জনক জেনেও অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন মসলায়, বিশেষ করে হলুদের গুঁড়াকে উজ্জ্বল হলুদ করা এবং ওজন বাড়ানোর জন্য সিসাযুক্ত রং লেড ক্রোমেট ব্যবহার করে থাকে। অবৈধ প্রসাধনী ও ওষুধ প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধেও সিসাযুক্ত রং ও উপাদান ব্যবহারের একই অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি তোমো হোজুমি সিসা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সম্পর্কে যা বলেছেন, তার মূল কথা হলো সিসা দূষণে আক্রান্ত শিশুকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় মানসিক ও শারীরিক বিকাশবিহীন এক অভিশপ্ত জীবনের দায়।

ছবি: প্রথম আলো

সিসা কেন অভিশাপ

সিসা হলো একজাতীয় বিষাক্ত ধাতু। যখন কোনো ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় সিসার সংস্পর্শে আসে, তখন তার মধ্যে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, সেগুলো হলো তলপেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, খাবারে অরুচি, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হাত বা পায়ে ব্যথা ইত্যাদি। এগুলো হয়তো সাময়িক। তবে নিয়মিত সিসার সংস্পর্শ জটিল ও দুরারোগ্য রোগব্যাধির কারণ হতে পারে।

বিশেষ করে মস্তিষ্ক, যকৃৎ (লিভার) ও কিডনির ক্ষতি করে সিসা। অনেক বিশেষজ্ঞ অতিরিক্ত মাত্রায় সিসা ক্যানসারের কারণ বলে মনে করেন। বুদ্ধ্যঙ্ক বা আইকিউ হ্রাস করে এটি। বিশেষত শিশু, কিশোরদের জন্য সিসা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। গর্ভবতী নারী ও গর্ভের ভ্রূণের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় এটি। তা ছাড়া গর্ভবতী নারীর রক্তে অতিরিক্ত সিসা অপরিণত শিশু জন্মের কারণ হতে পারে।

ছবি: প্রথম আলো

একজনের রক্তে সিসার মাত্রা নির্ণয় করে বলে দেওয়া সম্ভব যে সে কতখানি কম বা বেশি সিসার সংস্পর্শে আছেন। আসলে রক্তে সিসার কোনো সহনীয় মাত্রা নেই। তারপরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে যে শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা কোনোমতেই ৫ এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১০ মাইক্রোগ্রাম/ডিএলের বেশি হওয়া উচিত নয়। সিসার সংস্পর্শ সম্পর্কে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, নিয়মিত সিসার সংস্পর্শে এলে তা যেমন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি এবং অনেক ক্ষেত্রেই অকাল মৃত্যুরও কারণ।