হাল ছেড়ো না বন্ধু
ক্যানসারের সঙ্গে সর্বশেষ অসম যুদ্ধের কাল পেরিয়ে এসেছি বছর আটেক আগে। সর্বশেষ বলার কারণ, প্রথমে আমার মা, এরপর আমার স্ত্রী—এ দুজন মানুষের ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে পাশে থেকেছি আমি। দুজনেই এখন পর্যন্ত ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। এ অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক পরিণত আর সাহসী করেছে। আজ এই যুদ্ধ জয়ের কাহিনি হয়তো নতুন করে কাউকে সাহস জোগাবে, তাই বলা। এই দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি দিনের সহস্র ক্ষত সামলে বুকে হেঁটে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার যে কষ্ট আর যন্ত্রণা, তা কহতব্য নয়।
নিডল বায়োপসির রিপোর্টটায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল—ডাক্টাল কারসিনোমা। ক্যানসার। মুহূর্তে আমার স্ত্রীর মুখটিই ভেসে উঠেছিল কেবল। যার রিপোর্টটা আমার হাতে। সে অনুভূতি বোঝানো সম্ভব নয়। কষ্ট সামলে সবার আগে যা মনে হয়েছিল, তা হলো, পিছু হটা যাবে না। সামনে এগোতে হবে। যে মানুষটি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ; কোনো কিছু গোপন না করে, পাশে থেকে বুদ্ধি-শক্তি-সাহস জুগিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। পরে দেখেছি, ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তাঁর মনের সাহস। ক্যানসার হয়েছে, এ তথ্য জানার পর মুহূর্তেই পাল্টে যায় আক্রান্ত মানুষটির চেনা পৃথিবী।
সবার আগে যে বিষয়টির মুখোমুখি হয়েছি আমরা, সেটা হচ্ছে, ক্যানসার নিয়ে ছড়ানো নানা ভীতিকর গুজব। অনেকের গল্পেই সে সময় উঠে এসেছিল নানা নেতিবাচক বাস্তবতা। সেসব গল্পের ডালপালা মেলতে থাকে মাংসাশী উদ্ভিদের লতানো আঁকশির মতো। দুঃস্বপ্নেও হানা দেয় তা। একেকটা সময় খুব অসহায় আর নিঃসঙ্গ বোধ করার বিষয়টা খেয়াল করেছি। এমনকি চিকিৎসার মাঝামাঝি সময়ে যখন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি চেপে বসেছিল আমার স্ত্রীর শরীর ও মনে, সে সময় ‘চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে তো?’, এমন সন্দেহও তৈরি হয়েছে বহুবারই। অসংখ্য নির্ঘুম রাত এর সাক্ষী। সে সময় শত-সহস্রবার নিজেকে বোঝাতাম, ঘাবড়ানো যাবে না একদম। কারণ, আমি ঘাবড়ে গেলে শতগুণ অসহায় হয়ে পড়বে আমার প্রিয়তম মানুষটি।
সুচিকিৎসা কিংবা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা জেনেছিলাম খ্যাতনামা এক রেডিও অনকোলজিস্ট গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকের সংস্পর্শে আসার পরই। এর আগের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। একজন প্রবীণ চিকিৎসক, যিনি সার্জনও, শুধু নিডল বায়োপসি রিপোর্ট দেখেই ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষটির সামনে রীতিমতো হুংকার দিয়ে উঠেছিলেন, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে।’ পারলে তিনি তখনই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেন। আরেকজন চিকিৎসক হেলাফেলায় জানিয়েছিলেন, কেমো দিয়ে দেবেন, সেরে যাবে। আজ বুঝি, এই দুই মানসিকতার কোনোটিই অপকার ছাড়া ক্যানসারে আক্রান্তের কোনো উপকারে আসে না।
দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসার প্রতিটি দিন যেভাবে এগোয়, তার মধ্যে দৈনন্দিন কাজ, সন্তান, সংসার যেন তাকে আনন্দ দেয়, এ বিষয়টা নিশ্চিত করতে চেয়েছি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে সাহস ফিরিয়ে আনাটাও যেন অনেক বড় এক যুদ্ধ।
ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার আগের-পরের সময়টুকু আমাদের জীবনকে দিন আর রাতের মতোই আলাদা করে দিয়েছিল। কখনও ঢাকা, কখনও মুম্বাই: কেমোথেরাপির পর অপারেশন এরপর আবারও কেমো। তারপর টানা রেডিও থেরাপির দীর্ঘ সময়টুকুতে দেখেছি, সংসার, সন্তান—সবকিছু আঁকড়ে ধরার যে আকুতি, তা যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সে সময়গুলোতে পাশে থাকাটা খুব জরুরি। অন্তত নির্দিষ্ট একজনের, যে বন্ধুর মতো আপন হয়ে পাশে থাকবে। দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসার প্রতিটি দিন যেভাবে এগোয়, তার মধ্যে দৈনন্দিন কাজ, সন্তান, সংসার যেন তাকে আনন্দ দেয়, এ বিষয়টা নিশ্চিত করতে চেয়েছি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে সাহস ফিরিয়ে আনাটাও যেন অনেক বড় এক যুদ্ধ। নিজেকে কখনো আলাদা মানুষ, অসুস্থ মানুষ মনে করে সে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, এ বিষয়টাও সময়ে সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। অর্থব্যয়, চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি, বাড়তি যত্নের কারণে নিজেকে যেন কখনো সবার বোঝা মনে না করে, সে চেষ্টা করেছি।
একটা সময় মন খুব অসহায় আর নরম হয়ে পড়ে। সকাল-বিকেল-রাত পেরিয়ে শরীরও যেন ভেঙে আসে ক্লান্তিতে। কিন্তু দীর্ঘ চিকিৎসার একপর্যায়ে চিকিৎসকের মুখ থেকে যেদিন সে জানতে পারল, তার শরীরে আর ক্যানসারের অস্তিত্ব নেই! এ খবর কতটা যে চাঙা করেছিল তাকে! সেদিন বিকেলটার কথা আজও মনে আছে; সোনালি আলোয় চারপাশটা যেন ঝলমল করছিল। সেদিন মনে হয়েছিল, কী যুদ্ধই না ছিল একটা! অনেক কষ্ট আর ক্লান্তিকর এক সার্বক্ষণিক যুদ্ধ। যে যুদ্ধে আমরা হাল ছাড়িনি দুজনেই। আজ তাই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। আজ তাই সন্তানদের কাছে আবারও দুজন একসঙ্গে ঘরে ফিরতে পেরেছি।