মনের বন্ধু শিরোপা

২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশের ৭৫টি তৈরি পোশাক কারখানার সাড়ে ৩৭ হাজার পোশাকশ্রমিককে একক মানসিক কাউন্সেলিং সেবা দিয়েছে শিরোপার প্রতিষ্ঠান

শিরোপা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে চানছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

তৌহিদা শিরোপার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুঁ মারলে মনে হতে পারে, তিনি একজন পরিব্রাজক। আজ হয়তো খুলনার কামারখোলার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছবি দিচ্ছেন। পরদিনই দেখা গেল, তিনি আমস্টারডামে। কখনো প্যারিস, কখনো দিল্লি, কখনো বার্লিনে। চাকরি ছেড়ে যখন একটি মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, শুনে অনেকে হেসেছিল। আজ সেই প্রতিষ্ঠানের সুবাদেই তাঁকে ছুটতে হচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ‘মনের বন্ধু’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেশি-বিদেশি বেশ কিছু পুরস্কারও জিতেছেন তিনি।

চাকরি ছেড়ে যখন একটি মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, শুনে অনেকে হেসেছিল
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালে। আর ভাবনা? তারও আগে। শিরোপা জানালেন, ২০১৫ সালে গুরুতর মাত্রায় মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তাঁর মা। কিন্তু পরিবারের কেউই বিষয়টি টের পাননি। পরে মনোবিদের পরামর্শে শুরু হয় চিকিৎসা। একপর্যায়ে মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করতে করতে তিনিও কেমন যেন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখনই উপলব্ধি করেন, মানসিক অস্থিরতা কিংবা অবসাদে ভোগা একটা গুরুতর সমস্যা। কিন্তু বিষয়টি অনেকে আমলে নেন না। এ বিষয়ে কারও সঙ্গে মন খুলে আলাপও করতে চান না। মন খারাপের সময় বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতেই মনের বন্ধু চালুর পরিকল্পনা করেন তিনি। অল্প দিনের মধ্যেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের স্টার্টআপ বাংলাদেশের একটি প্রতিযোগিতায় জিতে পুরস্কারস্বরূপ তহবিল পেয়ে যাওয়ায় আরও বেগ পায় মনের বন্ধুর কার্যক্রম।

শুরু থেকেই শিরোপার লক্ষ্য ছিল, মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সুলভ ও সাশ্রয়ী করা। এই লক্ষ্যে মনের বন্ধু নামে একটি অ্যাপও চালু করেছেন। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিংসেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া খুলনার দাকোপ উপজেলার উপকূলবর্তী নারী, রংপুর-সৈয়দপুরের নারী স্বাস্থ্যকর্মী ও দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করছে শিরোপার দল।

প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ইউএন-উইমেন এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ড ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি (২০২২), জিজিইএস ইকো গেম চেঞ্জার অ্যাওয়ার্ড (২০২২), কমনওয়েলথ ডিজিটাল হেলথ অ্যাওয়ার্ড (২০২১), কল ফর নেশন (২০২০) অ্যাওয়ার্ডসহ দেশি-বিদেশি বেশ কিছু স্বীকৃতি পেয়েছে।

তবে শিরোপার লক্ষ্য আরও বহুদূর। এ লক্ষ্যেই নিজেকে ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের তৈরি করছেন তিনি। টমি হিলফিগারের পুরস্কারের অংশ হিসেবে ফ্রান্সের বিখ্যাত ইনসিড বিজনেস স্কুলে এক বছরের মেন্টরশিপ প্রোগ্রামে অংশ নেবেন শিরোপা। তিনি বলেন, ‘মনের বন্ধুর নিজস্ব একাডেমি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, সর্বোপরি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন আছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে চাই।’

মন খারাপের সময় বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতেই মনের বন্ধু চালুর উদ্যোগ নেন শিরোপা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

অনলাইনে-অফলাইনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি স্কুলপড়ুয়া শিশু থেকে শুরু করে পোশাকশ্রমিকদের জন্যও আছে মনের বন্ধুর বিশেষ প্রকল্প। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশের ৭৫টি তৈরি পোশাক কারখানার সাড়ে ৩৭ হাজার পোশাকশ্রমিককে একক মানসিক কাউন্সেলিং সেবা দিয়েছে শিরোপার প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে প্রায় দুই লাখ পোশাককর্মীকে দলগত কাউন্সেলিং দেওয়া হয়েছে। পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে দারুণ এই কাজের স্বীকৃতস্বরূপ বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড টমি হিলফিগারের আয়োজনে ‘টমি হিলফিগার ফ্যাশন ফ্রন্টিয়ার চ্যালেঞ্জ-২০২২’ পুরস্কার জিতেছে মনের বন্ধু। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য ১ লাখ ইউরো (১ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি)।

শিরোপা বলেন, ‘নারী পোশাকশ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। কিন্তু তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা কেউ ভাবেন না। শ্রমিকদের অনেকেই পরিবার ফেলে দূরে থাকেন বলে নানা রকম মানসিক অবসাদে ভোগেন। এ অবস্থায় তাঁরা টাকা খরচ করে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন, এটা ভাবাও অযৌক্তিক। তাই আমরা কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে কাউন্সেলিং সেশন জুড়ে দিয়েছি, যেন তাঁরা পণ্য কিনে সহজেই কাউন্সেলিং সেবা পেয়ে যান।’

করোনা মহামারির সময়েও অনলাইনে সেবা কার্যক্রম চালু রেখেছিল মনের বন্ধু। ঘরবন্দী মানুষ যখন বিভিন্নভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল, তখন মনের বন্ধুর কর্মীরা দিনরাত তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। ওই সময় অনলাইনে ৪০ ঘণ্টার একটি কোর্সও চালু করেছিল তারা। এই কোর্স পুরোপুরি সম্পন্ন করলে একজন সাধারণ মানুষও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জানতে পারবেন এবং অবসাদ-হতাশায় ভুগতে থাকা বন্ধুর পাশে প্রাথমিক সহায়ক হিসেবে দাঁড়াতে পারবেন। এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ মানুষ কোর্সটিতে নিবন্ধন করেছেন।