‘তখন পুরো পাহাড়ে আমি একা, বিশ্বাসই হচ্ছিল না বেঁচে আছি’

মাউন্ট ইয়ানামের পাশে তিন বন্ধু
ছবি: সংগৃহীত

২০১৯ সাল থেকে বান্দরবানের পাহাড়গুলোকে আপন করে নিয়েছিল খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) তিন স্নাতক—ইয়াছিন আরাফাত, শিশির কৈরী ও মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁদের পাহাড়ে চড়ার অভিযান কিন্তু অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। কেন? শিশির বলেন, ‘কীভাবে স্থানীয় মানুষ বা গাইডের সাহায্য ছাড়া পথ চিনে চিনে গভীরে যাওয়া যায়, বান্দরবানের বিভিন্ন পর্বতের চূড়ায় ওঠা যায়, সেটাই থাকত আমাদের উদ্দেশ্য। তাই যে পথে মানুষ কম যায়, আমরা সেই পথেই হাঁটতাম।’

তিন বন্ধু আবার তিন রকম। আরাফাতের ধ্যানজ্ঞানজুড়ে থাকে শুধু পর্বতের চূড়ায় ওঠার নেশা, শিশির আবার আশপাশের সংস্কৃতি, সমাজ, পরিবেশ বুঝতে আগ্রহী। অন্যদিকে মোস্তাফিজুর একদম ঠান্ডা মেজাজের। চুপচাপ পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে ছবি-ভিডিও ধারণ করাতেই তাঁর ভালো লাগা।

বাহ! এ তো পুরা রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার কিশোর-মুসা-রবিন!

তিনজন থেকে দুজন

ভিনদেশের কোনো সাদা পাহাড় জয়ের ইচ্ছে ছিল তিন তরুণ তুর্কির। খোঁজখবর করে ভারতের দুটি পর্বতচূড়া তাঁদের মনে ধরে—মানালির মাউন্ট ফ্রেন্ডশিপ ও লাদাখের কাং ইয়াতসে ২। গত ২১ জুন রাতে রওনা হন তাঁরা। বেনাপোল সীমান্ত হয়ে সোজা কলকাতা। সেখান থেকে ট্রেনে দিল্লি। দিল্লি থেকে বিমানে লাদাখের লেহ শহর। ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়া লেহে পৌঁছালেও এরপরই শুরু হয় নানা বাধাবিপত্তি।

পরিকল্পনা ছিল, দুই-তিন দিনের মধ্যে অনুমতি মিলে গেলে কাং ইয়াতসের পথে রওনা হবেন তিন বন্ধু। কিন্তু পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও অনুমতি মেলে না। এদিকে জরুরি কাজে মোস্তাফিজকে ফিরতে হয় দেশে। অগত্যা ২৯ জুন দুই বন্ধু যাত্রা করেন মানালির পথে। গন্তব্য—মাউন্ট ফ্রেন্ডশিপ।

দুজন থেকে একজন

মাউন্ট ফ্রেন্ডশিপ–যাত্রায় প্রথম দিন সবাই সাধারণত বাকারথাঁচ নামের একটা জায়গায় ক্যাম্পিং করে। পোর্টারের ইচ্ছেও ছিল তা–ই। কিন্তু ওই যে ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছে। আরাফাত আর শিশির জানিয়ে দেন, তাঁরা বেজক্যাম্পে গিয়ে রাত কাটাবেন। কারণ, পূর্বাভাস অনুযায়ী ২ তারিখে আবহাওয়া ভালো থাকার কথা। সেদিন চূড়ায় উঠতে হলে প্রথম দিনেই বেজক্যাম্পে পৌঁছানো চাই।

সন্ধ্যা প্রায় ৭টার দিকে তাঁরা ক্যাম্পে পৌঁছান। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। দুজনের তাঁবুতে পোর্টারসহ তিনজন কোনোরকম জবুথবু হয়ে রাত কাটান।

পরদিন চূড়ার দিকে এগোতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। কিছুতেই ভারসাম্য রাখতে পারছিলেন না শিশির। বারবারই পা হড়কে যাচ্ছিল, থেমে থেমে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। তাহলে কি পর্বতচূড়ায় না পৌঁছেই অভিযানের সমাপ্তি হবে? আরাফাতকে শিশির বোঝালেন, ‘অন্তত একজনের তো শেষ পর্যন্ত যাওয়া হোক। তুই যা। আমি আছি।’ বড় একটা পাথরের পাশে আশ্রয় নিলেন শিশির। আর বন্ধুদের হয়ে শৃঙ্গ জয় করতে এগোলেন আরাফাত।

মাউন্ট ফ্রেন্ডশিপের সামনে আরাফাত
ছবি: সংগৃহীত

দুর্ঘটনার মুখে

আরেকটু এগোলেই পর্বতচূড়ার একেবারে উঁচু অংশ। দড়ি (ফিক্স রোপ) ধরে আরাফাত যখন এগোচ্ছেন, অন্য দুটি দল তখন ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা সাবধান করে দিল, ‘ফিক্স রোপ ছাড়া উঠতে পারলেও ফিরে আসা সম্ভব না।’

আরাফাত বলেন, ‘তারা আসল সামিটের ১০ মিটার নিচ থেকে ফেরত গেছে। আমি কোনোভাবেই মনকে মানাতে পারিনি। এত কাছে এসে চূড়ায় না উঠে চলে যাব! তাই কথা না শুনে মুভ অন করি এবং ৯টা ৩৮ মিনিটে সামিট করি।’

চূড়া থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও
ভিডিও: ইয়াছিন আরাফাত

 ৫ হাজার ২৮৭ মিটার ওপরে তখন আরাফাত। শুরুতে সেলফি, পরে ৩৬০ ডিগ্রি একটি ভিডিও ধারণ করেন তিনি। আরাফাত বলেন, ‘সামনে ধৌলাধর রেঞ্জ, পীরপাঞ্জল রেঞ্জের যে দৃশ্য, তা ভোলা অসম্ভব। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয় এই বিশালতার মাঝে। নিচের দিক তাকিয়ে শিশিরকে খুঁজছিলাম। একটা বিন্দুও যদি দেখতে পাই, সেই আশায়।’

পর্বতারোহী দলটি যে মিথ্যা ভয় দেখায়নি, ফেরার পথে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। পা পিছলে পড়ে যান আরাফাত। এত দ্রুত পড়তে থাকেন যে আইস এক্স দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছিল না। শেষে যখন সফল হন, তখন গভীর এক খাদ থেকে তিনি মাত্র ১০-১৫ মিটার দূরে। আকস্মিক এ দুর্ঘটনার পর আরাফাতের রক্তবমি হয়। মুখ, হাত ও পেট বাজেভাবে থেঁতলে যায়। পাওয়ার গ্লাস, পোলারাইজড গ্লাস, পায়ের ক্যাম্পন কোথায় খুলে পড়েছে, কে জানে! আরাফাত বলেন, ‘তখন পুরো পাহাড়ে আমি একা, বিশ্বাসই হচ্ছিল না বেঁচে আছি। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই প্রাণে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল। এই শরীর নিয়ে চশমা, ক্র্যাম্পন ছাড়া একরকম নিস্তেজ অবস্থায় কোনোরকম নেমে আসি।’

৫ হাজার ২৮৭ মিটার ওপরে আরাফাতের ‘সামিট নোট’

বন্ধুত্বের শক্তি

মাউন্ট ফ্রেন্ডশিপ জয়ের ক্ষেত্রে কী সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে? এক মুহূর্ত না ভেবে আরাফাত বলেন, ‘আমাদের বন্ধুত্ব। ক্যাম্পাসজীবনের প্রথম থেকে আমাদের একসঙ্গে ওঠাবসা। চার বছরের বেশি সময় ধরে আমরা একসঙ্গে ভ্রমণ করি। সুন্দরবন সাইক্লিং, হিচহাইকিং বা বান্দরবানে বিভিন্ন অভিযান—সব জায়গায় এত কঠিন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি যে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া খুব ভালো।’ ভবিষ্যতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ আরও নিতে চান বলে জানালেন তিন তরুণ পর্বতারোহী।