শীতে বিড়াল-কুকুরসহ পোষা প্রাণী, পাখি ও মাছের যত্ন যেভাবে নেবেন
শীতকালে পোষা প্রাণীদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় মানুষের মতো প্রাণীদেরও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। বিভিন্ন রোগ ও শৈত্যপ্রবাহ থেকে আপনার পোষা প্রাণীকে সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা। খাবার থেকে শুরু করে আবাসন—সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
শীতে বিড়াল ও কুকুরের নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও মারাত্মক ফ্লু দেখা দেয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে এসবের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। খরগোশের ক্ষেত্রে ঠান্ডায় পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা ও কানের সংক্রমণ সাধারণ ঘটনা। পাখিরা ঠান্ডা বাতাসে দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটে। অন্য দিকে অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের জন্য পানির তাপমাত্রা কমে যাওয়া বিপজ্জনক। এতে মাছের হজমশক্তি নষ্ট হয়। ছত্রাকজাতীয় রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘শীতে পোষা প্রাণীকে নিরাপদ রাখতে রাত ও দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের ভেতরে রাখুন, দিনে অল্প সময় ব্যায়ামের সুযোগ দিন। বিড়াল ও কুকুর মূলত উষ্ণ রক্তের প্রাণী হলেও অতিরিক্ত ঠান্ডায় হাইপোথার্মিয়া ও মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ঠিকমতো যত্ন না নিলে প্রাণীদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয় ও ত্বকের প্রাকৃতিক তেল শুকিয়ে লোম পড়ার হার বেড়ে যায়। বিশেষ করে যথাযথ ভ্যাকসিনেশন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস না থাকলে শীতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ঘরের পোষা প্রাণীর জীবন বাঁচাতে ও দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা রোধে শীতকালীন বাড়তি যত্ন ও উষ্ণ আশ্রয় অপরিহার্য।’
বিড়াল ও কুকুরের বিশেষ যত্নবিড়াল ও কুকুর ঠান্ডায় খুব দ্রুত আক্রান্ত হয়। ঢাকার ‘টিনটিন ফস্টার হোম’–এর প্রতিষ্ঠাতা তানিহা হাসিনের তত্ত্বাবধানে আছে শতাধিক বিড়াল ও কুকুর। তিনি জানালেন, পোষা প্রাণীর যেকোনো অসুস্থতায় নিজ থেকে ওষুধ, যেমন নাপা বা প্যারাসিটামল না দেওয়াই ভালো। প্যারাসিটামল বিড়াল-কুকুরের যকৃৎ বিকল করে দিতে পারে। মৃত্যু হতে পারে। ওষুধের ডোজ সব সময় একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি সার্জন বা ভেটের থেকে জেনে নিতে হবে।
এ সময় যা করতে পারেন
১. বাইরের প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে পোষা প্রাণীকে ঘরের ভেতরেই রাখুন। জানালা ও দরজা বন্ধ রাখুন, যাতে ঠান্ডা বাতাস না ঢোকে।
২. বিড়াল ও কুকুরকে ঠান্ডা মেঝেতে শুতে দেবেন না। কার্টনের বক্সে নরম কম্বল বা পুরোনো আরামদায়ক কাপড় বিছিয়ে দিন। মনে রাখবেন, বিড়াল বা কুকুর সাধারণত বাড়তি জামা পরতে পছন্দ করে না, তাই তাদের শোয়ার জায়গাটি উষ্ণ রাখা বেশি কার্যকর।
৩. শীতের আগেই কিংবা যত দ্রুত সম্ভব ফ্লু এবং র্যাবিস ভ্যাকসিন নিশ্চিত করুন। এতে ওদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।
৪. এ সময় পরিষ্কার পানি (সম্ভব হলে কুসুম গরম পানি) দিতে হবে। কুকুর-বিড়াল নিজের আগ্রহে পানি কম খায় বলে পানিশূন্যতার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে লবণ ও মসলা ছাড়া মুরগি সেদ্ধ করা পানি খাওয়াতে পারেন। একে বলা হয় মুরগির স্টক। এই পানীয় একবেলা দেওয়া যেতে পারে।
৫. মসলা-তেল-লবণ ছাড়া সেদ্ধ মুরগি, এক টুকরা মিষ্টিকুমড়া অথবা গাজর সেদ্ধও দিতে পারেন। সপ্তাহে এক দিন ডিমের কুসুম অথবা মুরগির কলিজা সেদ্ধ দেওয়া যায়। চাপিলা ও সুরমার মতো সামুদ্রিক মাছ প্রতিদিন দেওয়া যাবে না।
৬. মুরগি খেতে চায় না অনেক বিড়াল। সে ক্ষেত্রে অল্প মাছ মিশিয়ে দিলে খাবে। হালকা গরম, তাজা খাবার দিতে হবে। নিয়মিত লিটার বক্স পরিষ্কার রাখতে হবে। মেঝে সব সময় শুকনা ও পরিষ্কার রাখতে হবে।
৭. কোনোভাবেই দুধ, চকলেট বা মিষ্টিজাতীয় খাবার দেবেন না। চকলেটে থাকা রাসায়নিক উপাদান বিড়ালের জন্য বিষাক্ত। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখুন খুব প্রয়োজন না হলে শীতে গোসল করানো থেকে বিরত থাকুন। বিড়ালের জিবে থাকা ‘প্যাপিলি’ বা ‘টেস্ট বাড’ প্রাকৃতিকভাবেই ওদের শরীর পরিষ্কার রাখে। বারবার গোসল করালে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয়ে যায় এবং নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। শীতে বিড়ালকে বারবার গোসল করালে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, লোমের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয়।
এ ছাড়া রুমে হিটার চালালে তা কখনোই জনশূন্য অবস্থায় রাখা যাবে না। হিটার একটানা বেশিক্ষণ চালালে বাতাসে আর্দ্রতা কমে গিয়ে প্রাণীর শ্বাসকষ্ট বা মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া হিটারের ওপর কোনো কাপড় রাখা বিপজ্জনক। প্রাণীদের ক্ষতস্থানে পরামর্শ না নিয়ে অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করবেন না। এসব ক্ষতিকর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভায়োডিন ব্যবহার করা নিরাপদ।পাখি ও মাছের যত্নশীতকাল পোষা পাখিদের জন্য বেশ সংবেদনশীল সময়। পাখিরা খুব দ্রুত তাপমাত্রা পরিবর্তন অনুভব করে, যা ওদের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এ সময় যা খেয়াল রাখতে পারেন—
১. সরাসরি ঠান্ডা বাতাস লাগলে পাখিদের শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটে, যা দ্রুত নিউমোনিয়ায় রূপ নিতে পারে। তাপমাত্রা কমে গেলে পাখিদের বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। এতে বদহজম বা পাতলা পায়খানা হতে পারে।
২. শরীর উষ্ণ রাখতে না পারলে পাখি পালক ফুলিয়ে এক কোণে বসে থাকে ও খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। বাতাস থেকে পাখিকে রক্ষা করুন। খাঁচা এমন জায়গায় রাখুন, যেখানে সরাসরি ঠান্ডা বাতাস না যায়। জানালার খুব কাছে খাঁচা রাখবেন না। রাতে খাঁচার তিনদিক মোটা কাপড় বা চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিন। একদিক খোলা রাখুন, যেন অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক থাকে।
৩. শীতে রুম হিটার চালালে বাতাস শুষ্ক হয়ে যায়, যা পাখির জন্য ক্ষতিকর। তাই হিটারের পাশে পানির বাটি রেখে আর্দ্রতা বজায় রাখুন। খাঁচার ভেতর বা খুব কাছে একটি ৬০–১০০ ওয়াটের ফিলামেন্ট বাল্ব জ্বালিয়ে দিন। এটি পাখিকে প্রয়োজনীয় উষ্ণতা দেবে। তবে খেয়াল রাখবেন, বাল্বটি যেন পাখির শরীর স্পর্শ না করে।
৪. দিনে অন্তত ২-৩ বার পানি পরিবর্তন করে হালকা কুসুম গরম পানি দিন। ঠান্ডা পানিতে পাখির সর্দি লাগতে পারে।
৫. শীতে সূর্যমুখীর বীজ বা খাবার দানার পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দিন। এসব শরীরে শক্তি ও তাপ উৎপন্ন করে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পানিতে মাল্টি-ভিটামিন এবং ইলেকট্রোলাইট মিশিয়ে দিতে পারেন।
৬. যদি দেখেন আপনার পাখিটি ঝিমুচ্ছে, চোখ বন্ধ করে রাখছে বা লেজ নামিয়ে শ্বাস নিচ্ছে, তবে দ্রুত কোনো ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শ নিন। পাখিদের রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
৭. মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামের পানির তাপমাত্রা নির্দিষ্ট রাখতে থার্মোস্ট্যাট বা হিটার ব্যবহার করুন।
৮. শীতকালে মাছের হজমপ্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়, তাই অতিরিক্ত খাবার দেবেন না।