আমি শুধু ‘ছুটির দিনে’ই লিখি

গীতিকার ও প্রথম আলোর ‘আপনার রাশি’–এর লেখক কাওসার আহমেদ চৌধুরী মারা গেছেন। আজ মঙ্গলবার রাত ৯টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর এই লেখা প্রথম আলোর ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছাপা হয়েছিল ‘কেমন করে এলাম’ শিরোনামে। এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী এখন ছবির মানুষ

কিশোর বয়সে আকাশবাণী কলকাতা থেকে এক নারী কণ্ঠশিল্পীর রেকর্ড শুনতাম, হয়তো আপনারও শুনেছেন: কেমন করে এলাম সে যে অনেক কথা...।

আমি যে কীভাবে প্রথম আলোতে লিখতে শুরু করলাম, তার পেছনে কিছু মজার ইতিহাস আছে। শুনতে চাইলে বলতে পারি। যাগ্গে, ধরে নিচ্ছি আপনি শুনতে চান। তাহলে এবার বলি, ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলো আত্মপ্রকাশ করল। ১৯৯৯-এর কোনো এক সময়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান অর্থাৎ আমাদের মতি ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। আপনি তো জ্যোতিষ চর্চা করেন; তাহলে আমাদের পত্রিকায় রাশিফল লিখতে শুরু করুন। আমি একটু ভয় পেলাম। মতি ভাই বললেন—কেন, আপত্তি আছে? আমি আমতা আমতা করে বললাম, আপনি তো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, আপনি কেন এসব বিশ্বাস করেন? তিনি বললেন, এটা একটা বিশ্বজনীন আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশের পত্রপত্রিকায় নিয়মিত রাশিফল ছাপানো হয় পাঠকের মানসিক চাহিদা পূরণের জন্য। তারপর তিনি একটু বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, যা দেখতে পাচ্ছি, আপনি তো একজন একগুঁয়ে ধরনের লোক। আমি নিচু কণ্ঠে বললাম, আপনিও তো কম যান না। মতি ভাই ফাইল থেকে চোখ তুললেন, কী বললেন? আমি বললাম, না, কিছু না। এই তো মোটামুটি আমার রাশিফল লেখা শুরু হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, রাশিফল যখন লিখতেই হবে, তাহলে এখানে অঙ্কের কিছু যুক্তি আনা যাক। একটি কিশোরকে নিয়ে সারা রাত জেগে প্রতিটি রাশির ভর বের করলাম। অর্থাৎ, গ্রহ–নক্ষত্রের অবস্থান দিয়ে যে রাশি, তার সঙ্গে পিথাগোরাসের নিউমারলোজি মিশিয়ে নিলাম। এর সঙ্গে মিশ্রণ ঘটালাম আমার সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের।

প্রথম দিকে তেমন ফিডব্যাক আসত না। আস্তে আস্তে লোকে আমার ট্যাং ফং নং বা টেলিফোন নম্বর জোগাড় করে আমাকে ফোন করতে লাগল, বিশেষ করে শনিবার সকালে। প্রথম দিকের একটা ঘটনা মনে পড়ল। এক মহিলা শনিবার সকালে আমাকে ফোন করে বলতেন, আপনে এই সব কী লেখেন? আমার কিচ্ছু মেলে না, কেডা আপনাকে রাশিফল লেখায়? আমি আপনার সব ফাইজলামি বন্ধ করব। প্রথম আলোতে ফোন করব, যেন তারা আপনার এই সব আবোলতাবোল লেখা ইস্টপ করে। যে শনিবারে মহিলা আমাকে ফোন করতেন না, সেই শনিবারে আমি বুঝতাম তিনি আমার রাশিফলে মোটামুটি সন্তুষ্ট। তবে, আজ এই পনেরো বছর পরও ওই মহিলার কর্কশ কণ্ঠ আমি মিস করি। একবার এক পাঠক আমাকে টেলিফোনে বললেন, আপনার রাং ফং (রাশিফল) অং বং চং কখনো স্লগ ওভারের ব্যাটিংয়ের মতো ছক্কা হয়ে উড়ে যায়, আবার কখনো উইকেটটা চলে যায় আপনার ধনু রাশির চালক গ্রহ বৃহস্পতির দিকে। এভাবে আর কত দিন চালাবেন? তখনি আমার মনে পড়ল মতি ভাইসহ অন্যদের মুখ। আমার একগাল দাড়িভর্তি মুখটাও মনে পড়ে গেল। আর মনের চক্ষু ক্যামেরার একটা প্যান শটে কল্পনা করলাম, লাখ লাখ পাঠকের বিরক্তি এবং একই সঙ্গে কৌতুকপূর্ণ চেহারা। আরে, এই সব কী লিখে যাচ্ছি আমি! তবু প্রথম আলো এবং ‘ছুটির দিনে’ যে পথে যায়, আমিও সেই পথেই যাই। পেছনে তাকিয়ে দেখি, কবে যেন একে একে পনেরোটি বছর চলে গেছে। আর দেখি, আমি কোনো নিঃস্ব মানুষ নই; যদিও আমার কথা ওয়ান ওয়ে চ্যানেলে অনেকের কাছে পৌঁছে যায় এবং নানাভাবে আমার কাছে ফিরে আসে।

পাঠক, জানিয়ে রাখি, আমার রাশিফলের কোথাও কোনো শাখা নেই। একমাত্র প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ই রাং ফং লিখি। অন্য কোথাও নয়, অন্য কোনো মাধ্যমেও নয়। যদি কেউ ভাবেন, আমি অন্যত্র রাশিফল লিখছি, তো সেই ভুল ধারণার দায়িত্ব আমি নেব না। নাই–বা হলো বিজ্ঞান, নাই–বা হলো কাজের কিছু। আমি রাশিশাস্ত্র তথা জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্য দিয়ে এক কিম্ভূত চরিত্রে পরিণত হলাম। ঠিক বললাম কি না জানি না। আমার ছোট্ট একটা বই আছে জ্যোতিষশাস্ত্র শেখার। বইয়ের এক জায়গায় আমি ছোট্ট কয়েক লাইন কবিতায় যুক্তি রেখেছি, কেন আমি কিশোর বয়স থেকে আজ অবধি জ্যোতিষচর্চা ছাড়তে পারলাম না। কবিতাটি এ রকম—

আমি শুধু এক দরিদ্র জ্যোতিষী

ধরে আছি গাঢ় অন্ধকারে

তোমার দক্ষিণ হাত

ভয় কি, তুমি পার হয়ে যাবে এই

তুফানি ঝড়ের রাত।