ঈদের দিনেও তাঁদের ক্লাস, পরীক্ষা

ঈদে সবার ‘স্বপ্ন বাড়ি যায়’ না। অনেকে এমনকি ছুটিও পান না। দেশের বাইরে আমাদের যে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করছেন, ক্লাস-পরীক্ষা বা কাজের মধ্যেও ঈদের আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। কয়েকজনের অভিজ্ঞতা শুনেছেন মো. জান্নাতুল নাঈম

গত বছর ঈদে ক্লাস করেছি

কানাডার অটোয়া প্রদেশের কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছেন বি এম আরিফুজ্জামান। পড়ালেখার বিষয় তথ্যপ্রযুক্তি। গত বছর প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে ঈদ করেছেন এই শিক্ষার্থী। বলছিলেন, ‘গত বছরও ঈদের দিন ক্লাস করেছি। একটা ক্লাসে ৩০ জনের মধ্যে হয়তো দুজন মুসলমান। ফলে দুজনের জন্য সবার ক্লাস বা পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানাতে ঠিক মন সায় দেয় না। তবে এখানে ধর্ম দিয়ে কেউ একে অন্যকে বিচার করেন না। সব ধর্মের প্রতি সবাই সম্মান দেখান। গত ঈদের নামাজ শেষে পাঞ্জাবি পরে ডাউনটাউনে হাঁটছিলাম। এ সময় বেশ কয়েকজন খ্রিষ্টধর্মী কানাডীয় হাসিমুখে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।’

কানাডার অটোয়া প্রদেশের কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছেন বি এম আরিফুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

আরিফ জানালেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও উৎসবের আয়োজন করা হয়। নির্দিষ্ট একটি ঘরে থাকে খাবারের ব্যবস্থা। ক্লাস শেষে অবসর সময়ে সেখানে গিয়ে উদ্‌যাপন করেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া কয়েকটা জামাত হয় বলে ক্লাস করেও অনেকে নামাজ আদায় করতে পারেন। ‘বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের সঙ্গেই ঈদের খুশি ভাগ করে নিই,’ বলছিলেন আরিফ।

কেক খেয়ে ঈদের দিন কেটেছে

নতুন জায়গা ও পরিস্থিতিতে ভিন্ন রকম যাপিত জীবনের গল্প শোনালেন শালিমা বিনতে মনির। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ম্যারিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পিএইচডি শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু করি। করোনার কারণে তখন অনলাইনে ক্লাস হতো। রুমমেট ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কাউকেই চিনতাম না। সেবার রোজার ঈদের দিন ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। রুমমেটও ছুটি নিয়ে আগেই আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। বাসায় আমি একা। এত এত পড়াশোনা, শিক্ষকের সহযোগী হিসেবে কাজের চাপ, সব মিলিয়ে বুঝতেই পারিনি যে ঈদ চলে গেল। রান্না করারও সময় পাইনি। শুধু কেক খেয়েই ঈদের দিন কেটেছে।’

২০২২ সালে ক্যাম্পাস খোলা ছিল। কিন্তু সবার সঙ্গে আনন্দ করার বদলে জুটেছিল গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ। বলছিলেন, ‘সেই ঈদে প্রকল্প জমা দেওয়া ও উপস্থাপনের দায়িত্ব পড়েছিল। তাই আলাদা করে দিনটির অস্তিত্ব টের পাইনি। বাংলাদেশ থেকে পরিবারের পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তায় ঈদের কথা মনে পড়েছে। সবচেয়ে ভালো কেটেছে ২০২৩-এর ঈদ। ক্লাস ছিল, তবে কোনো পরীক্ষা ছিল না। সেবারই প্রথম ক্লাস শেষে ঈদ উপলক্ষে রান্না করেছি। পরিচিতদের বাসায় আসতে বলেছি। বেশ ভালো সময় কেটেছে। আশা করি, ২০২৪ সালও ভালো যাবে।’

আরও পড়ুন

অফিস থেকে ছুটি পাইনি

মধ্য ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে পড়ালেখা করেন তাহমিনা জামান। ভ্রোসোয়াফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার দূরের এই দেশটিতে তাহমিনার প্রথম ঈদ ছিল গত বছর। কেমন কেটেছে সময়?

মধ্য ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে পড়ালেখা করেন তাহমিনা জামান
ছবি: সংগৃহীত

‘ভ্রোসোয়াফ শহরে খুব ছোট একটা মসজিদ আছে। সকালে ঈদের নামাজ শেষে মসজিদের খোলা আঙিনায় সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। জাতি, বর্ণ ও সংস্কৃতিনির্বিশেষে এ যেন এক মিলনমেলা। বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা তাঁদের রান্না করা হরেক রকমের পদ নিয়ে হাজির হন। বাকি আয়োজন করা হয় মসজিদের তহবিল থেকে। গত ঈদের দিন ক্লাস বাদ দিয়েই উৎসবে অংশগ্রহণ করেছি। লিখিত কোনো পরীক্ষা থাকলে অবশ্য অংশ নিতেই হতো। তবে অফিস থেকে ছুটি পাইনি। দুপুরের পরে ঠিকই কাজে যেতে হয়েছে। একটু কষ্ট হয়েছে। ভেবেছি, বাংলাদেশে থাকলে আজকে নিশ্চয়ই পরিবারের সঙ্গে সারা দিন উপভোগ করতে পারতাম।’

তবে রমজান মাসজুড়ে সান্ধ্যকালীন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা কঠিন ছিল। অধ্যাপকের কাছে ছোট্ট বিরতি নিয়ে ইফতার সারতে হতো। ধর্মের প্রতি শিক্ষকের শ্রদ্ধা দেখে অনেক ভালো লেগেছে বলেও জানালেন তিনি।

যতটা ভেবেছিলাম, ততটা খারাপ কাটেনি

অস্ট্রেলিয়ার এডিথ কাওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ালেখা করছেন তাজ্জামুল হোসেন। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থে থাকেন তিনি। প্রকৌশলের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘দ্বিতীয়বার দেশের বাইরে ঈদ করছি। গতবার সবার সঙ্গে মিশে যাওয়া একটু কঠিন ছিল। পরিবারকে যেমন মিস করেছি, বাড়িতে রান্না করা সুস্বাদু খাবারগুলোও মিস করেছি। দিনটা অবশ্য যতটা ভেবেছিলাম, ততটা খারাপ কাটেনি। বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। আগে খাওয়া হয়নি, এ রকম নতুন নতুন খাবারের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ধর্মীয় উৎসবের দিনে পড়াশোনা ও পার্টটাইম চাকরির ভারসাম্য রাখাটা একটু কঠিন। তবে গত ঈদে দেখেছি, শিক্ষকদের জানিয়ে ক্লাস বাদ দেওয়া যায়। ক্লাসের রেকর্ড থাকায় পিছিয়ে পড়ার ভয় নেই। কিন্তু পরীক্ষা থাকলে নামাজ শেষ করে পরীক্ষায় অংশ নিতেই হয়।’

অস্ট্রেলিয়ার এডিথ কাওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ালেখা করছেন তাজ্জামুল হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

ভিডিও কলে মায়ের নির্দেশনা শুনে বা ইউটিউব দেখে নিজেও অনেক নতুন পদের রান্না শিখেছেন তাজ্জামুল। সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। ফলে নতুন মনন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে ভিন্ন রকম ভালো লাগায় কেটেছে তাঁর ঈদ।

ঈদের জামা পরে ক্লাসে গিয়েছি

চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ছোট্ট শহর ইয়ান। পাহাড়ে ঘেরা এই শহরটিতে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়। তাই বৃষ্টির শহর নামেই খ্যাত। বৃষ্টির শহরের ঈদগুলো কেমন হয়? শুনুন রাশিদুর রহমানের বয়ানে, ‘ছুটি না পেলেও নিজেদের মতো করে দিনটা রঙিন করার চেষ্টা করি।’

সিচুয়ান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে মাস্টার্স করছেন এই তরুণ। তাঁর ভাষ্য, ‘ঈদের দিনে মুসলিম শিক্ষার্থীরা যে যাঁর দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে একসঙ্গে হেঁটে নামাজে যাই। নামাজ শেষে স্থানীয় চীনা মুসলিম সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিই। করোনা মহামারির পরের প্রথম ঈদে আমাদের অধিকাংশের ক্লাস ছিল ঠিক মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পরেই। আমরা ঈদের পোশাক পরেই ক্লাস করেছি। এর পর থেকে ঈদের দিন ঈদের পোশাক পরে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া একটা সুন্দর রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।’

চীনা সহপাঠী ও অন্য আন্তর্জাতিক বন্ধুদের নিয়ে ঈদ করেছেন রাশিদুর (ডান থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: সংগৃহীত

রাশিদুর রহমানের পরনে পাঞ্জাবি দেখে নাকি শিক্ষক এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। সব শুনে শিক্ষক নিজেও শুনিয়েছেন তাঁর ছেলেবেলার কথা, তাঁদের সংস্কৃতির কথা। রাশিদুর রহমান বলেন, ‘ঈদের দিন সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে, যেখানে আমাদের নিজ নিজ দেশের খাবার, সংগীত ও ঘরোয়া খেলার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে চীনা সহপাঠী ও অন্য আন্তর্জাতিক বন্ধুরা অন্যদের সংস্কৃতি ও প্রথার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এই ধরনের অনুষ্ঠান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধের একটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে।’