আফিমজাতীয় ওষুধের আসক্তি নিখুঁতভাবে বের করার পদ্ধতি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের রামিসা

আফিমজাতীয় ওষুধ অপিওয়েডে কেউ আসক্ত কি না বা কোন ধরনের অপিওয়েডে আসক্ত, নমুনা পরীক্ষা করে নিখুঁতভাবে বের করার পদ্ধতি এত দিন ছিল না। সেই পদ্ধতিই উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের মেয়ে রামিসা ফারিহা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রামিসা বর্তমানে উচ্চসংবেদনশীল নিউক্লিওসাইড শনাক্তকরণের পদ্ধতি তৈরির কাজেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নতুন উদ্ভাবনের বিস্তারিত শুনেছেন রাফিয়া আলম

বাংলাদেশের মেয়ে রামিসা ফারিহা যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটছবি: রামিসা ফারিহার সৌজন্যে

সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে একটি শিশুর কথা ভাবুন। তার মা যদি অপিওয়েডে আসক্ত হন, তবে মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয়েই তার শরীরে প্রবেশ করেছে সেই বিষ। মাতৃগর্ভেই অপিওয়েডে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তার দেহ। ব্যাপারটা অপিওয়েড আসক্তির মতোই ভয়াবহ। জন্ম নেওয়ার পর কিন্তু মায়ের রক্তের অপিওয়েড আর তার দেহে প্রবেশ করছে না। সেই সময় অপিওয়েডের অভাবে ভুগতে থাকে ওই একরত্তি দেহ। ফলে তার ছোট্ট শরীরে দেখা দেয় মারাত্মক প্রভাব, যার নাম নিওনেটাল অ্যাবস্টিনেন্স সিনড্রোম। আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। রামিসা ফারিহার দলের উদ্ভাবনটি এই নবজাতকদেরও কাজে লাগবে।

মরফিন বা কোডিনের নাম হয়তো শুনেছেন। এ রকম কিছু ওষুধের ‘গ্রুপ’ হলো অপিওয়েড। বিশেষ ধরনের ব্যথানাশক। অস্ত্রোপচার–পরবর্তী ব্যথার মতো বিশেষ কিছু প্রয়োজনে অপিওয়েড ব্যবহার করা হয়। তবে অপব্যবহারও করেন বহু মানুষ। মার্কিন মুলুকে অপিওয়েড আসক্তির হার ভয়াবহ। অন্যান্য দেশেও অপিওয়েডের অপব্যবহার হতে দেখা যায়। একজন মানুষ আদৌ অপিওয়েডে আসক্ত কি না, কোন ধরনের অপিওয়েডে আসক্ত—চিকিৎসার জন্য এসব তথ্য জানার প্রয়োজন পড়ে। তবে নমুনা পরীক্ষা করে নিখুঁতভাবে তা বের করার পদ্ধতি এত দিন ছিল না। সেই পদ্ধতিই উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশের মেয়ে রামিসা ফারিহার নেতৃত্বে গবেষক দল। তাঁদের এ গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, নেচার, সায়েন্স ডিরেক্টসহ বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার প্ল্যাটফর্ম।

গবেষক দলের সদস্যদের সঙ্গে রামিসা (ডান থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: রামিসা ফারিহার সৌজন্যে

শুরুর গল্প

অপিওয়েড আসক্তি নিয়ে কাজ করেন ব্রাউন স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ক্যারোলিনা হ্যাস–কফলার। কিন্তু প্রয়োজনীয় সব তথ্য না পাওয়ায় মুশকিলে পড়ছিলেন এই চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক। তাই সাহায্যের জন্য ব্রাউন স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক অনুভব ত্রিপাঠির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অধ্যাপক ত্রিপাঠির অধীনে পিএইচডি করে এই প্রতিষ্ঠানেই পোস্টডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছেন রামিসা ফারিহা। পিতৃতুল্য এই অধ্যাপকই রামিসাকে চ্যালেঞ্জটা নিতে উৎসাহ দেন। সেখান থেকেই শুরু এই যাত্রা।

রামিসা বলছিলেন, ‘মাদকাসক্ত ব্যক্তির নমুনা হিসেবে পরীক্ষার জন্য রক্ত বা প্রস্রাব নেওয়ার চল আগে থেকেই ছিল। তবে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের রক্তনালি কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে বলে পর্যাপ্ত রক্তের নমুনা সংগ্রহটাই বড় চ্যালেঞ্জ। প্রস্রাবের নমুনাও পরীক্ষা করা হয়, তবে অপিওয়েড আসক্তির ব্যাপারে সব সময় তা নির্ভুল ফলাফল দেয় না। আর প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো নমুনা থেকেই দেহে অপিওয়েডের সঠিক মাত্রা নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু এই মাত্রা জানা থাকলে চিকিৎসার সময় কাউকে বাড়তি মাত্রায় ওষুধ দেওয়ার ঝুঁকি থাকে না।’

তাই রামিসার দলকে এমন কিছু আবিষ্কার করতে হতো, যাতে সব কটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। নবজাতকদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করাও কঠিন। আর নিওনেটাল অ্যাবস্টিনেন্স সিনড্রোমের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকেরা চট করে ধারণাও করতে পারেন না যে এতটুকু শিশুর অপিওয়েডের অভাবে এমন সমস্যা হচ্ছে! এ ব্যাপারটিরও সুরাহা করতে চাইলেন রামিসার দল।

রামিসা ফারিহা
ছবি: রামিসা ফারিহার সৌজন্যে

রামিসার দলের উদ্ভাবন

গবেষণা করতে গিয়ে মাত্র ২০ মাইক্রোলিটার রক্তের নমুনা থেকেই প্রয়োজনীয় সব তথ্য বের করার পদ্ধতি বের করে ফেললেন রামিসা ও তাঁর দল। তার মানে, আঙুলের মাথায় ছিদ্র করে নমুনা সংগ্রহ করেই কাজটা করা যাবে। এমনকি নবজাতকদের ক্ষেত্রে রক্তের শুকনা দাগ থেকেও বের করা যাবে প্রয়োজনীয় সব তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া সব শিশুর পায়ের গোড়ালি থেকেই পাঁচ ফোঁটা রক্ত নেওয়া হয়। ফোঁটাগুলোকে শুকিয়ে নবজাতকের স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয়। সংগৃহীত প্রতিটি ফোঁটার ব্যাস হয় ৩০ মিলিমিটারের মতো। রামিসাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে এই রক্তের শুকনা দাগের মাত্র ৩ মিলিমিটার অংশ ব্যবহার করেই অপিওয়েড–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাবে। নিওনেটাল অ্যাবস্টিনেন্স সিনড্রোমে আক্রান্ত নবজাতকের ক্ষেত্রে জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই এসব তথ্য পাওয়া জরুরি। অর্থাৎ সময় নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ পাওয়াও মুশকিল। এসব চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই রামিসাদের কাজ করতে হয়েছে। তাঁর দলের উদ্ভাবিত রোবোটিক পদ্ধতিতে কাজটি করতে কত সময় লাগে, জানেন? মাত্র তিন মিনিট!

রামিসা ফারিহা বড় হয়েছেন নারায়ণগঞ্জে
ছবি: রামিসা ফারিহার সৌজন্যে

নারায়ণগঞ্জের রামিসা

রামিসার জন্ম নারায়ণগঞ্জে। বড়ও হয়েছেন সেখানেই। ২০১৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষাজীবন থেকেই নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুনিয়ায় উল্লেখযোগ্য বহু কাজ করেছেন রামিসা; পেয়েছেন নানা সম্মাননা ও স্বীকৃতি। ব্রাউন স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কোর্স ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি জনসন অ্যান্ড ওয়েলস ইউনিভার্সিটিতেও পড়ান তিনি। পিএইচডির সময় থেকেই ক্ষুদ্র নমুনা নিয়ে কাজ করেছেন। সেই জ্ঞানও কাজে লেগেছে এবার। তবে কেবল উন্নত দেশের নামকরা পরীক্ষাগারেই প্রযুক্তিকে আটকে থাকতে দিতে চান না রামিসা। পরীক্ষার জন্য শুকনা রক্ত খুব সহজে কম খরচে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে পাঠিয়ে দেওয়ার সুযোগও দেখেন তিনি। এভাবে প্রযুক্তির সুবিধা পাবে গোটা পৃথিবীর মানুষ, এমনটাই স্বপ্ন হাসিখুশি এই বিজ্ঞানীর।

আরও পড়ুন