বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখায় অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালা
ছোটবেলা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক তথ্যচিত্র, ভিডিও কিংবা স্টিফেন হকিংয়ের বক্তব্য মুগ্ধ হয়ে দেখতেন হাসিবুল হোসেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহটা তখন থেকেই। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন, কোন বই পড়বেন, কাদের কাছেই বা যাবেন—কিছুই জানতেন না। অগত্যা অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন। লাইব্রেরি ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে বইয়ের খোঁজ। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে দেশে কোনো সম্মেলন, সেমিনার বা কর্মশালা হলেও হাজির হয়ে যেতেন তিনি। এভাবেই এক সেমিনার থেকে জানতে পারেন জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের কথা। বুয়েটে অনুষ্ঠিত সেই অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন হাসিবুল। পুরস্কার হিসেবে জিতে নেন আ স্টুডেন্টস গাইড টু দ্য ম্যাথম্যাটিকস অব অ্যাস্ট্রোনমি নামের বইটি।
দেশ-বিদেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে নিতে বেশ ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে হাসিবুলের। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থায় (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন, সংক্ষেপে আইএইউ) এক বছর স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজও করেছেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) পদার্থবিজ্ঞানের এই ছাত্র।
হাসিবুল ভাবছিলেন, যে বাধাগুলো তিনি পেরিয়ে এসেছেন, দেশের অন্য ছেলেমেয়েরাও নিশ্চয় একই বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কীভাবে তাঁদের যাত্রাটা সহজ করা যায়, এই ভাবনা থেকেই ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি শুরু করেন জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালা।
শুরুটা হয় স্কুলের এক ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। একজন থেকে দুজন, দুজন থেকে পাঁচজন, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সদস্যসংখ্যা। বর্তমানে এই পাঠশালায় কাজ করছেন ফাহিম আহমেদ, মুহাম্মদ ওয়াসি, রায়হানা মীম, মৌপিয়া তাজরিন, পায়েল দাস, নিশাত বিনতে গণি, হাবিবুর রহমান, হুমায়রা শওকতসহ ৪০ তরুণের একটি দল। তাঁদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যুক্ত হয়েছেন তাঁরা।
অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালা সবার জন্য উন্মুক্ত। বয়স, বিভাগ বা শ্রেণির ভেদাভেদ এখানে নেই। স্কুলশিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিমানের পাইলটও পাঠ নেন। কেউ কেউ হয়তো মানবিক বা ব্যবসায়িক শিক্ষার ছাত্র, তাঁরাও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠ নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। মূলত বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান বোঝানো হয় বলেই এই পাঠশালার প্রতি দেশের শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হয়েছেন বেশি।
কিছু কিছু কোর্সে নিবন্ধন করতে হলে ফি লাগে। যাঁরা বিনা মূল্যে পাঠ নিতে চান, তাঁদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে চলে নানা রকম লাইভ ক্লাস। যে কেউ তাতে অংশ নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা করতে পারেন।
উদ্যোক্তারা জানান, অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালায় প্রতিদিন বিনা মূল্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান শিখছেন ২০-৩০ হাজার শিক্ষার্থী। সাপ্তাহিক রুটিন মেনে চলে এই কার্যক্রম। ফেসবুক, ইউটিউব, ওয়েবসাইট মিলিয়ে এরই মধ্যে অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালার সংগ্রহে যুক্ত হয়েছে ১ হাজার ৫০০–এর বেশি ইনফোগ্রাফিকস। এ ছাড়া ভিডিও, ক্লাস, স্মার্ট নোট, কুইজ, জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোর্স, কর্মশালা—এসব তো আছেই।
হাসিবুল জানান, মেন্টর খুঁজে পেতে তাঁদের বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। তা ছাড়া তেমন কোনো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। হাসিবুল হোসেনের টিউশনির টাকা, বিভিন্ন কোর্স, কর্মশালা থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে চলে জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখানোর কার্যক্রম। ব্যক্তিগত শ্রেণিকক্ষ বা অফিসও তাঁদের নেই। বাসার সিঁড়িঘরের ছোট্ট একটা ঘরকে বানানো হয়েছে অফিস। সেই অফিসে একসঙ্গে পাঁচজন ঢুকলেই ‘ভিড়’ হয়ে যায়। এর মধ্যেই গাদাগাদি করে বসে, দাঁড়িয়ে, ট্রাইপড দাঁড় করিয়ে চলে ভিডিও নির্মাণ।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যেন জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ পান, জ্যোতির্বিজ্ঞানী কিংবা নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে ভয় না পান, সেটিই অ্যাস্ট্রোনমি পাঠশালার লক্ষ্য। শত বাধা নিয়েই তাই কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা।