আমাদের কথা বুঝতে পৃথিবীর দুই দশক সময় লেগেছে

এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ড্রিউ ওয়াইজম্যান ও ক্যাটালিন কারিকো। করোনা রোধে এমআরএনএ টিকা আবিষ্কারে ভূমিকা রাখার জন্য তাঁদের এ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার অধ্যাপক ড্রিউ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রেরই ব্র্যানডাইস ইউনিভার্সিটিতে। নিজ ক্যাম্পাসে তিনি সমাবর্তন বক্তৃতা দিয়েছেন গত ২১ মে।

ড্রিউ ওয়াইজম্যান
ছবি: এএফপি

১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আমি এই ক্যাম্পাসেরই ছাত্র ছিলাম। তোমাদের তখনো জন্ম হয়নি। একজন বিজ্ঞানী, কিংবা একজন মানুষ হিসেবে আমার গড়ে ওঠার পেছনে ব্র্যানডাইস ইউনিভার্সিটির ভূমিকা বিশেষ ‍গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই গড়ে ওঠে আমার বিশ্লেষণী চিন্তার দক্ষতা। প্রফেসর গ্যারি ফ্যাসম্যানের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে করতেই আমি জেনেছি, কিসে আমার আগ্রহ। কীভাবে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে খোলামনে কাজ করতে হয়, তা-ও তো এখানেই শেখা।

আরও পড়ুন

আমার স্ত্রীর সঙ্গেও এই ক্যাম্পাসেই দেখা হয়েছিল। এখন সে একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি তাঁকে ক্যালকুলাস শিখিয়েছিলাম। যদিও জুতা কেনার প্রতি তাঁর সীমাহীন আগ্রহের উদাহরণ দিয়ে যেভাবে ইনফিনিটির (অসীম) ধারণা বুঝিয়েছিলাম, সেই অংশটা ছাড়া আর কিছুই ওর মনে নেই।

আমি ও আমার সহযোগী ক্যাটালিন কারিকো যখন এমআরএনএকে চিকিৎসাবিদ্যার কাজে লাগানোর উপায় খুঁজে পাই, তখনো জানতাম না, এটি একদিন একটি বৈশ্বিক মহামারি ঠেকাতে কাজে আসবে। নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধে এর অসীম সম্ভাবনা আজ থেকে ২৫ বছর আগেই আমরা ধরতে পেরেছিলাম। সে কারণেই বহু বাধা, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকাশনাগুলোর প্রত্যাখ্যান, তহবিলের অভাব সত্ত্বেও আমরা কখনোই কাজ বন্ধ করিনি।

এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ড্রিউ ওয়াইজম্যান ও ক্যাটালিন কারিকো। করোনা রোধে এমআরএনএ টিকা আবিষ্কারে ভূমিকা রাখার জন্য তাঁদের এ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে
ছবি: এএফপি

আমরা যা বলতে চাচ্ছিলাম, তা অনুধাবন করতে এবং আমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে বাকি পৃথিবীর প্রায় দুই দশক সময় লেগে গেছে। আজ এমআরএনএ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্তে পৌঁছেছি। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের মাধ্যমে সংক্রামক রোগের মোকাবিলা করা সম্ভব। জিনগত অসুখ নিরাময় সম্ভব। এমনকি ‘নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের উপযোগী ওষুধ’ও তৈরি করা সম্ভব।

এমআরএনএ প্রযুক্তির সম্ভাবনা অসীম। কিন্তু এই আবিষ্কার কাজে লাগবে তখনই, যখন এটি মানুষের কাছে পৌঁছাবে। ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কোভিড ১৯-এর টিকার অন্তত একটি ডোজ হলেও পেয়েছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় টিকা পাওয়া মানুষের সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সমতা তখনই আসবে, যখন প্রতিটি রাষ্ট্র সুস্বাস্থ্য রক্ষার সব ধরনের সুবিধা পাবে। এই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না শুধু পদ্ধতিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কারণে। এসব বাধা দূর করতে যা যা করা দরকার, পৃথিবীর একজন বাসিন্দা হিসেবে সবকিছু করার দায়িত্ব তো আমাদেরই।

আরও পড়ুন

এ কারণেই আমি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে গবেষণার অবকাঠামো গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছি। বিজ্ঞানী, সরকার, ওষুধ ও বায়োটেক কোম্পানি, দাতাদের সহায়তায় আমরা থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউক্রেন, ব্রাজিল, ভারতসহ নানা দেশে ১৮টি এমআরএনএ গবেষণা ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।

স্থানীয় গবেষকেরা যেন তাঁদের নিজ এলাকার চ্যালেঞ্জ ও চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসাপদ্ধতি ও টিকা উদ্ভাবন করতে পারেন, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। ভবিষ্যতে যদি আবার কোনো মহামারি আঘাত হানে, তাহলে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর পাশাপাশি এ দেশগুলোও সমানতালে টিকা বিতরণ করতে পারবে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্য আমরা কমিয়ে আনতে পারব।

ক্যানসার থেকে শুরু করে বৈশ্বিক উষ্ণতা, নানা দুর্বোধ্য সমস্যা আমরা বুঝতে পারি বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে। কিন্তু শূন্যতার মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা হয় না। নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখলে কখনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। আইডিয়া বিনিময়, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যাকে দেখা এবং এক হয়ে কাজ করার মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন আর মানুষের উন্নয়ন—দুটো একযোগে করা সম্ভব। বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার চর্চাকে স্বাগত জানাও। এর মধ্য দিয়েই তোমরা পরিবর্তন আনতে পারবে। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনূদিত