সন্তানকে সময় দিতে ব্যস্ততা দূরে রাখবেন যেভাবে

বাবার ব্যস্ত থাকলেও সন্তানের জন্য সময় রাখতে হবে। মডেল: রাসিন ও রাজনছবি: কবির হোসেন

মনে পড়ে, ছোটবেলায় মাছ খেতে চাইতাম না। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে বাবা বাসায় আসার সুযোগ পেতেন। নব্বইয়ের দশক। মফস্বল শহর। ক্যাম্পাসেই বাসস্থান ছিল বলে বাবা সেই সময়টুকু ব্যয় করতে পারতেন একমাত্র কন্যার সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার কাজে। নিজে চটজলদি খেয়ে নিতেন, তাঁর সঙ্গে বসে আমার অপছন্দের খাবারগুলোও গল্পে গল্পে সাবাড় করে ফেলতাম। রাতেও গল্প শোনাতেন বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। বাবার সঙ্গে সন্তানের গুণগত সময় কাটানো নিয়ে লিখতে বসে প্রথমে সেসব দিনের কথাই মনে এলো। ইচ্ছা থাকলে কিন্তু আজকের বাবারাও নিজেদের কাজের সময়ের মধ্যেই এমনিভাবে যুক্ত করে নিতে পারেন সন্তানকে। সন্তানপালন তো কেবল মায়ের দায়িত্ব নয়, বাবার ভূমিকাও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্যস্ত বাবার জীবনে এ–ও যে এক মস্ত কাজ।

ভিন্ন যুগের ভিন্নমাত্রা

আমাদের জীবন এখন জীবিকাপ্রধান। কেবল কাজ আর কাজ। অনলাইন কাজ, অফলাইন কাজ। অনেকেরই আবার বেশ কিছুটা সময় চুরি করে নেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সপ্তাহান্তে ক্ষণিকের অবসরটুকু ছাড়া আজকের বাবা হয়তো নিজেকে নিয়ে ভাবারও সময় পান না। অফিস ৯টায় হলে কী হবে, জ্যামের যন্ত্রণায় হয়তো ঘর থেকে বের হচ্ছেন আরও ঘণ্টা দুই আগে, সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার তাড়াও থাকতে পারে। তবে এত কিছুর মধ্যেও বেড়ে ওঠার রঙিন সময়ে বাবার আঙুল ধরার সুযোগ প্রতিটি সন্তানেরই থাকা দরকার।

যা করতে পারেন

সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন। হয়ে উঠুন তার ভরসার জায়গা। শিশুর সঙ্গে কথা বলুন নিয়মিত। ভাগ করে নিন নিজের কথা। আপনার শৈশব কেমন ছিল, ওর বয়সে আপনি কী করতেন, এমন নানান কথা আলাপ করুন। ওকে নিয়ে বই পড়ুন, ওর সঙ্গে ছবি আঁকুন কিংবা খেলুন।

অনলাইনে না, সন্তানকে নিয়ে খেলুন সরাসরি। মডেল: রাসিন ও রাজন
ছবি: কবির হোসেন

বাইরে নিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো, সম্ভব না হলে ঘরেই খেলুন, তবে ডিজিটাল মাধ্যমে নয়। হতে পারে সেটা শব্দ খুঁজে বের করা কিংবা ছন্দ মেলানোর খেলা। ছোট বাসা! তাতে কী? একটা বারান্দাই হয়ে উঠতে পারে ওর স্টুডিও। সেখানেই চলুক না আঁকিবুঁকি। আপনিও যোগ দিন। কিংবা ওকে নিয়ে বাগান করুন। ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের কাজও করুন। সব বাবা হয়তো দুপুরে সময় পাবেন না, তবে রাতের খাবারটা অন্তত সন্তানের সঙ্গে বসে খেতে চেষ্টা করুন। সপ্তাহান্তে তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারেন।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান। অসহায় মানুষ আর প্রাণীদের জন্য কিছু করতে উৎসাহ দিন। বাবা হয়তো আর্থিক সহায়তা করছেন কাউকে কিংবা খাবার দিচ্ছেন, এই কাজটুকুই ওর হাত দিয়ে করান। পথের প্রাণীদের ভালোবাসতে শেখান। শিশুর মনটা উদার হবে।

শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি হোক ইতিবাচক

অন্যের প্রতি সম্মানবোধের প্রথম শিক্ষাটা শিশু পরিবার থেকেই পায়। শিশুর সামনে কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না।

কেউ খাটো, কেউ লম্বা, কেউ ফর্সা, কেউ কালো; আবার কেউ ছেলে, কেউ মেয়ে। লিঙ্গভেদ কিংবা শারীরিক গড়ন স্রষ্টার দান। কাউকেই ছোট করে দেখতে নেই, মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতে নেই। ছোট থেকেই এসব স্বাভাবিক বিষয় অঙ্কুরিত করে দিন সন্তানের মনে।

মায়ের প্রতি বাবার আচরণ দেখে শিশু সামাজিক পরিসরে নারীর অবস্থানের প্রাথমিক ধারণা পায়। মা-বাবার দাম্পত্যজীবন পরবর্তীকালে তার দাম্পত্যজীবনেও প্রভাব ফেলে। বিশেষত কন্যাশিশু পরবর্তী জীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে কিংবা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে। স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক হিসেবে আপনার সন্তান বেড়ে উঠুক, এমনটা নিশ্চয়ই চাইবেন না। তাই সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলুন, পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন।

পথ চলতে গিয়ে অচেনা নারীর প্রতি বাবার আচরণ কেমন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত পুত্রসন্তানের জন্য। বাবা যদি অচেনা নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করেন, পথ ছেড়ে দেন, আগে যেতে দেন, গণপরিবহনে নারী ও বয়স্কদের আসন ছেড়ে দেন এবং অচেনা নারীর চলার পথে অস্বস্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ান, তা দেখে সন্তানও বড় হতে হতে এসব গুণ রপ্ত করে ফেলবে।