যেমন রায়েরবাজারে শিশুরা বেড়ে উঠতে চায়

রায়েরবাজারে বসবাস করা ২৩৬ স্কুলশিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা কেমন শহর চায়ছবি: সংগৃহীত

শিশুরা যখন মাঠে খেলে, তখন তাদের মা-বাবা মাঠের পাশে অপেক্ষায় থাকেন। প্রখর রোদে বা তাপপ্রবাহে তাঁদের দরকার একটুখানি ছায়া। তাই মাঠের পাশে মা-বাবাদের জন্য দু-একটি বৃক্ষের আবদার করেছে এক শিশু। আরেক শিশুর চাওয়া, রাস্তার কাছে একটি টেলিফোন। বিদ্যালয় ছুটির পরে বাসায় একবার ফোন করার সুযোগ দরকার তার। তবে অনেক শিশুর ভাবনাতেই রয়েছে সবুজ প্রকৃতি। যেখানে প্রয়োজনীয় গাছগাছালি একটি ছায়াশীতল পরিবেশ তৈরি করবে। এমনই ছোটখাটো বা নিতান্ত নস্যি চাওয়া ঢাকার রায়েরবাজারের শিশু-কিশোরদের। কংক্রিটের জঞ্জালে ঠাসা ঢাকায় শিশুদের বিকাশে কেমন নগর–পরিকল্পনা দরকার, শিশুদের কল্পনা থেকে তা তুলে আনতে চেয়েছে ‘রায়েরবাজার টু গ্রো-আপ ইন’ কার্যক্রম।

বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর আ ব্যাটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’ কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করেছে। যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল জোগানো ও গবেষণায় রেখেছে বিস্তৃত ভূমিকা। রায়েরবাজারের ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কয়েক মাসব্যাপী বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের কল্পনাকে নকশায় ফুটিয়ে তুলতে কাজ করেছে তারা। শিশুরা তাদের ভাবনার নগরের কথা তুলে ধরেছে কর্মশালায়।

আরও পড়ুন
শিশুরা বলছে তার মনের মতো শহরের কথা
ছবি: সংগৃহীত

শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য যে ধরনের নগর–পরিকল্পনা দরকার, ঢাকা শহরে তার ঠিক কতখানি বজায় রয়েছে? বর্তমান বাস্তবতা আর শিশুবান্ধব ভবিষ্যতের চিত্র শিশুদের কল্পনা থেকে হাতে-কলমে তুলে আনাই ছিল এই কর্মসূচির লক্ষ্য। শিশুরা যে রকম রায়েরবাজার চায়, সেই রকমের একটি রায়েরবাজারের নকশা উপস্থাপন করে দেখিয়েছে এই কার্যক্রম। রায়েরবাজারের শিশুরা এখন যে পরিবেশে বেড়ে উঠছে, সেই পরিবেশের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছে। পরে তারা ঠিক করেছে, রায়ের বাজারের পরিবেশ ঠিক কেমন হলে তাদের জন্য ভালো হয়। সেই বিষয়গুলো নানা উপায়ে শিশুদের কাছ থেকেই শোনা ও বোঝার চেষ্টা করেছেন প্রকল্পের রূপকারেরা। শিশুরা তাদের কল্পনাকে অঙ্কন ও বক্তব্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে। উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ, গবেষকসহ অংশীজনেরা নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের কথা শুনেছেন। তাঁরা শিশুদের ভাবনার নকশাগুলো (রায়েরবাজারের মানচিত্রের ওপর শিশুদের ভাবনার প্রতিফলন) প্রদর্শনী করে মতামত জানতে চেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের। শিশুরা উদ্যোক্তাদের সহায়তায় নিজের এলাকার রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদির ম্যাপিং করে বাস্তব অবস্থাকে চোখের সামনে এনে বুঝতে চেয়েছে কী, কেন তাদের অপছন্দ। একইভাবে কোনটিতে বা কিসে তাদের ভালো লাগা। সেই অনুযায়ী এলাকার খুঁটিনাটি একেবারে মানচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে বড়দের দেখাতে চেয়েছে, তারা কেমন পরিবেশ চায়। রায়েরবাজারে এখন কিসের ঘাটতি রয়েছে। শিশুরা দিনের কোন অংশে কী ধরনের খেলাধুলা করে। সচরাচর কখন, কোথায় ও কীভাবে তাদের সময় কাটে। কর্মশালায় অংশ নেওয়া প্রায় সব শিশুই ভবিষ্যতে নিরাপদ ও বাধাহীন, পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত, সবার জন্য সবুজে ঘেরা ও খেলাধুলাময় রায়েরবাজার দেখতে চায়। ভবিষ্যতের এই রায়েরবাজার গড়ে তুলতে কোথায় কী ধরনের কাজ করতে হবে, মানচিত্রের নকশায় তা ধরিয়ে দিয়েছে তারা।

আরও পড়ুন
শিশুদের কল্পিত নগর–পরিকল্পনা নিয়ে প্রদর্শনী
ছবি: সংগৃহীত

শিশু-কিশোরদের নকশায় ফুটে উঠেছে কোন রাস্তাটিকে তারা নিরাপদ, বাধাহীন ও নিশ্চিন্তে হাঁটাচলার জন্য উন্মুক্ত দেখতে চায়। নালা ও জলাশয়গুলোর দেখাশোনা করাও জরুরি মনে করেছে তারা। প্রবেশাধিকারসহ সবুজ খেলার মাঠ তাদের একটি প্রধান চাওয়া। শিশুদের কল্পিত এই নগর নকশার বাস্তবায়ন সম্ভব হওয়া মানে, একটি সবুজ ঢাকা গড়ে ওঠা, যেখানে কার্বন-সিসায় ভারী হয়ে ওঠা বাতাসের বদলে জায়গা করে নেবে নির্মল আর বিশুদ্ধ বাতাস।

শিশুদের কল্পিত এই নগর–পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত, গবেষণা ও বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতায় কাজ করেছে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর পরিকল্পনা, ভূগোল, স্থাপত্যবিদ্যা, নগর উন্নয়ন, পরিবেশবিদ্যাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষক দল। তারা স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনা সুপারিশ করেছে।

গত বছরের ২১ অক্টোবর থেকে রায়েরবাজারে বসবাস করা ২৩৬ স্কুলশিক্ষার্থীকে নিয়ে ওয়ার্কশপ পরিচালনার মাধ্যমে কাজটি শুরু হয়। লালমাটিয়ার দ্য ইলিউশন গ্যালারিতে ১০ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় প্রদর্শনী। ১৫ ফেব্রুয়ারি অংশীজনদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ডায়ালগ। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব জিওগ্রাফি অ্যান্ড প্ল্যানিং’-এর অধ্যাপক ও প্রকল্পের প্রধান গবেষক মাতলুবা খান অংশীজনদের নিয়ে আয়োজিত সংলাপে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি শিশুরা নগর ভবনে গিয়ে দেখা করে আসে প্রশাসকের সঙ্গে। তারা নিজেদের কল্পনায় আঁকা রায়েরবাজার তথা ঢাকা শহরকে যতটুকু সম্ভব বাস্তবে দেখতে চায়।

আরও পড়ুন