দেশীয় উপকরণে যেভাবে সাজানো হয়েছে এই থাই রেস্তোরাঁ

এই রেস্তোরাঁর নকশার মধ্যে সহজেই নজর কাড়ে বনেদিয়ানা।
ছবি: জুনায়েদ হাসান

বাজারের ব্যস্ততা আর ফুডকোর্টের হইচইকে পাশ কাটিয়ে ওপরতলায় যেতেই মন শান্ত হয়ে গেল। এক পাশে স্পা, আরেক পাশে থাই এমারেল্ড রেস্তোরাঁ। মূল সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময়ই চারপাশের কোলাহল হারিয়ে যায় হঠাৎ করে। নরম আলোয় স্বাগত জানায় থাই এমারেল্ড।

সাধারণত রেস্তোরাঁয় মূল চরিত্রে থাকে খাবারটাই। স্বাদ, পরিবেশন আর দাম নির্ধারণ করে দেয় এই রেস্তোরাঁ সফল হবে, না মুখ থুবড়ে পড়বে। তবে তারও আগে মানুষ রেস্তোরাঁটায় যাবে কি না, সেটা ঠিক করে এর অন্দরের আবহ। একটু ডানে–বাঁয়ে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, অন্য সবকিছুর মতো দর্শনটাও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। ধানমন্ডির ৮/এ–তে অবস্থিত থাই এমারেল্ডের নকশায় যেন গাম্ভীর্য, নমনীয়তা ও আভিজাত্য—সব কটি বিষয়ই উপস্থিত আছে। খাবারের পাশাপাশি এই রেস্তোরাঁর তিনটি শাখাই প্রশংসিত নকশার কারণে।

কোন ভাবনায় নকশা

ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে লাগানো কাঠের ব্লক
ছবি: জুনায়েদ হাসান

আরএমএ আর্কিটেক্টের স্বত্বাধিকারী ও প্রধান স্থপতি রাফিয়া মারিয়াম আহমেদ জানালেন, ৩ হাজার ৫০০ বর্গফুটের রেস্তোরাঁটি সাজানো হয়েছে এমনভাবে, ঢোকার সময়ই যেন মনে একটা রহস্য খেলে যায়। চিকন লাইন দেওয়া পার্টিশন ও আলো-আঁধারি পরিবেশ এ অনুভূতি বাড়িয়ে তুলবে আরেকটু। পুরো জায়গা নকশা করার সময় রাফিয়া গুরুত্ব দিয়েছেন রেস্তোরাঁর খোলামেলা পরিবেশে। এ কারণে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত জানালার ওপর দেননি বাড়তি কোনো আবরণ। কিন্তু চাইলেই অতিথিরা যেন আলাদা আর একান্ত (কোজি) একটু জায়গাও সহজে পেয়ে যান, সেটাও নকশায় আছে।

থাই এমারেল্ডের প্রথম শাখা চালু হয় ২০১২ সালে, উত্তরায়। কাজ শুরু করার আগে হাতির বড় একটি ছবি কিনেছিলেন। থাইল্যান্ডে হাতির বড় একটি ভূমিকা আছে। বিষয়টি তুলে ধরার জন্যই হাতির ছবি আনা। এটা যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ধানমন্ডির এই ৩ নম্বর শাখার কাজ শুরুর আগেও কেনা হয়েছে হাতির বড় একটা ছবি, লাগানো আছে এক কোনায়। 

আরও পড়ুন

সবেতেই কমফোর্ট

ছক ধরে বসানো হয়নি চেয়ার–টেবিল
ছবি: জুনায়েদ হাসান

রেস্তোরাঁয় অতিথিদের আরামের অনেকাংশ নির্ভর করে নকশার ওপর। ছোট থেকে ছোট বিষয়গুলোও এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সোফার উচ্চতা কত হবে, পার্টিশনের ওপর আয়নার ব্যবহার, কী ধরনের বোর্ড ব্যবহার করা উচিত, সেটার ঘনত্ব কতটুকু হবে, চেয়ারের উপকরণ কী হবে, পুরো জায়গাটির রঙের সমন্বয় কেমন হলে ভালো, টেবিল ল্যাম্পের কাপড় আর রংই–বা কী হবে, দেয়ালে লাগানো ছোট টেবিলল্যাম্পটি গোল হবে, নাকি চারকোনা; দেয়াল থেকে কতটুকু দূরে থাকবে—সবকিছুর নকশা নির্ধারণের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে।

থাই এমারেল্ডের প্রতিটি জিনিস বানানো হয়েছে দেশীয় উপকরণ আর কারিগরদের দিয়ে। গাছের টবগুলোও বাদ যায়নি। এভাবে কাজের একটা আলাদা মজা আছে বলে জানালেন রাফিয়া। কারিগরেরাও উৎসাহ বোধ করেন। নকশায় বারবার পরিবর্তন আনলেও তাঁরা বিরক্ত বোধ করেন না। ছাই, বাদামি আর সবুজের নানা শেড ঘুরেফিরে এসেছে রেস্তোরাঁর ভেতর। মাটির কাছাকাছি থাকার একটা অনুভূতি খুঁজে পাওয়া যাবে এখানে সহজেই, তবে সেটা আভিজাত্য রেখে।    

কাঠ–বেতের নকশা

থাই এমারেল্ডের প্রতিটি জিনিস বানানো হয়েছে দেশীয় উপকরণে
ছবি: জুনায়েদ হাসান

রেস্তোরাঁর নকশায় মূলত প্রাধান্য পেয়েছে বেত, কাপড় আর কাঠ। খেয়াল করলে দেখা যায়, তিনটি নকশার চেয়ার–টেবিল আছে। কিন্তু তিনটি নকশার ভেতরেই কোনো না কোনো মিল আছে। ছক ধরে চেয়ার–টেবিল বসানো হয়নি। একঘেয়েমি যাতে না আসে, এ কারণে একেক জায়গায় একেক ধরনের সেটিং প্রাধান্য পেয়েছে।

নকশার ব্যাপ্তি কখনো টেবিলের পায়া থেকে চলে গেছে ক্যাশ কাউন্টারের এক অংশে, সেখান থেকে আবার পার্টিশনে, সেখান থেকে আবার ছোট ছোট ক্যাবিনেটে। একইভাবে থাইল্যান্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক পদ্মফুলকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা কায়দায়। ঢোকার মুখে মূল দরজাতেই ফুটে উঠেছে পদ্ম। সেখান থেকে ভাসতে ভাসতেই যেন চলে গেছে পোডিয়ামে, সেখান থেকে ক্যাশ কাউন্টারে। মূল কয়েকটি নকশাই নানা জায়গায় এসেছে বেশ একটা ছন্দ রেখে।

ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে লাগানো সাধারণ কাঠের ব্লকগুলো দেখেও বেশ মজা লাগল। ব্লকের দোকানে গিয়ে ওখানেই বসে ঠিক করা হয়েছে, কোনটার পর কোনটা বসবে। ব্লকের বিমূর্ত নকশাগুলোই দেয়ালের ওপর তৈরি করে দিয়েছে আলাদা একটা চিত্র।                                                       

আরও যা

কলাম ধরে রেস্তোরাঁর মাঝবরাবর দেওয়া হয়েছে পার্টিশন।
ছবি: জুনায়েদ হাসান

কলাম ধরে পার্টিশন দেওয়া হয়েছে রেস্তোরাঁর মাঝবরাবর। বিষয়টি না জানলে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। পার্টিশনের দুই দিকেই বসার জায়গা। বড় দল এলে অনায়াসেই বসতে পারবে। আলাদা দুটি প্রাইভেট রুম আছে। ১০ জনের বেশি বসতে পারবে অনায়াসে। এই দুটি রুমের দরজা বন্ধ রাখা যায়, আবার চাইলে খোলাও রাখতে পারবেন। দরজাগুলো বন্ধ থাকলে পদ্মগুলো পুরো থাকে, খুলে দিলে সেগুলোও বেশ শৈল্পিকভাবে আধা নকশা হয়ে আটকে থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু থাই রেস্তোরাঁ, সে কারণে পদ্মের ব্যবহার হয়েছে। থাইল্যান্ডের প্রতীক হলেও ফোটানো হয়েছে বাংলাদেশি উপকরণ দিয়ে।

দরজা, ক্যাবিনেট, পার্টিশন, এমনকি ছোট আয়নাগুলোর বিটে গোলাকার একটা ভাব রাখা হয়েছে। এতে পুরো নকশায় চলে এসেছে নমনীয়তা। ফলস সিলিং ব্যবহার করা হয়নি। রাফিয়া জানালেন, ‘আমাদের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি। ফলস সিলিংয়ে ড্যাম্প পড়ে যায়, পোকামাকড় জমে। ফলস সিলিং না দিলে উচ্চতাটাও পাওয়া যায়। খোলা ভাব থাকে। মূল রেস্তোরাঁর বাইরে রাখা হয়েছে বাথরুম, স্টোরেজ ও রান্নাঘর।’

এই রেস্তোরাঁর নকশার মধ্যে বনেদিয়ানা নজর কাড়ে সহজেই। ঢোকার মুখে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত লম্বা দরজাটি দেখলেই সেটা মনে হয়। দরজার ওপর আছে পুরোনো দিনের খড়খড়ির লাইন, পুরো করিডর ধরে চলে গেছে একই নকশার ল্যাম্প। প্রায় ছয় মাস ধরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা এই রেস্তোরাঁর কোনায় কোনায় শৈল্পিক ভাবনার ছোঁয়া আছে; যা বয়ে গেছে বেশ সহজাতভাবে। এটাই যেন নকশার ক্ষেত্রে আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে ধানমন্ডির থাই এমারেল্ডে।

আরও পড়ুন