নতুনভাবে আঁকা আলপনায় দুর্গোৎসবের আমেজ টিকইলের বাড়িতে বাড়িতে
নতুনভাবে আঁকা আলপনায় দুর্গোৎসবের আমেজ প্রকাশ পাচ্ছে আলপনা গ্রাম হিসেবে খ্যাতি পাওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের টিকইলে। গত সোমবার বিকেলে গ্রামে ঢুকে একাধিক বাড়ি গিয়ে দেখা যায় নারীদের ব্যস্ততা। দেখন বর্মণের মেয়ে অনিতা বর্মণের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তুলসীতলায় ও তুলসী বেদিতে সাদা খড়িমাটির রঙে আলপনা আঁকছেন তিনি। এর আগে তিনি গোটা বাড়ির দেয়ালচিত্র নতুন রঙে রাঙিয়েছেন। একাদিক বাড়িতেই চলছে এই আয়োজন। আলপনার এই নতুন সাজ উৎসবের আমেজ এনেছে গ্রামজুড়ে। গুঁড়া রং, তুলি আর পাতলা কাপড়—এ তিন জিনিস দিয়ে রং করা হয় দেয়াল থেকে দেয়ালে।
গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে টুলটুলি বর্মণ (৪০) বাড়ির বাইরের মাটির দেয়াল লেপাপোছা করছেন আলপনা আঁকার উপযোগী করতে। ভেতরে মাটির দেয়ালগুলো আঁকা শেষ করেছেন। শেষে ধরেছেন বাইরের সীমানাদেয়াল। ষষ্ঠীর আগেই সবকিছু শেষ করতে হবে। তাই তিনি হাত চালিয়ে কাজ করে চলেছেন আপন মনে। বেশি কথা বলার সময় কম তাঁর হাতে।
আর একটু এগিয়েই চোখে পড়ে ‘আলপনা বাড়ি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া দেখন বর্মণের (৬২) বাড়ি। দেখার মতোই সব আলপনা, দেয়ালচিত্রগুলো চোখ জুড়াবে আপনার। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। দেখন বর্মণের হাত ধরেই আলপনা পেয়েছে নতুন রূপ। ফুল, পাখি, নদী ও গ্রামীণ নারী, নৌকা ও মাঝি, নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের ছবি আছে দেয়ালচিত্রে। গোটা বাড়ির কোনো দেয়াল, মেঝে, বারান্দা ও বাঁধানো তুলসীতলা—কোথাও ফাঁকা নেই আলপনা ও দেয়ালচিত্র ছাড়া। দেখা যায়, দেখন বর্মণ বাড়ির বাইরের বারান্দায় বসে রংতুলি নিয়ে পরম মমতায়œবাইরের দেয়ালে আঁকছেন একমনে। জানালেন, পূজার এই সময়ে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসে। দূরদূরান্ত থেকে আসেন দর্শনার্থীরাও। তাঁরা দেখে মুগ্ধ হন, উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করেন। তখন খুব ভালো লাগে। তবে এসব নিজের মনের আনন্দেই করা। মনের রঙেই এসব রাঙানো হয়। ঝকঝকে–তকতকে দেয়ালে আলপনার রং দেখে মন প্রফুল্ল থাকে। তখন কষ্ট করে আঁকা সার্থক মনে হয়। আলপনা গ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আলপনা বাড়িটি গড়ে তুলতে পেরে গর্বও অনুভব করেন তিনি।
প্রায় সারা বছর দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে এই বাড়িতে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে এই বাড়ি দেখতে। এ বাড়িতে গেলে যে কারও মনে হবে দেখার মতোই বাড়ি এটি। আলপনা আঁকার স্বীকৃতিস্বরূপ বছরখানেক আগে তিনি পেয়েছেন জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয়েছে স্বর্ণপদকসহ ৯০ হাজার টাকা। গ্রামের নেতৃস্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তি পরেশ চন্দ্র বর্মণ (৭০) লাঠি হাতেই হেঁটে হেঁটে গ্রামের আরও বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখালেন গ্রামের নারীদের দক্ষ হাতে আঁকা সব আলপনা। তিনি জানান, গ্রামের সব বয়সী নারী এ সময়ে আলপনা আঁকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। নারীদের আঁকা এসব আলপনার সুবাদে ‘আলপনা গ্রাম’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে গ্রামটি। তার আসল ‘টিকইল’ নামটি হারাতে বসেছে। তবে এই সুবাদে জেলা প্রশাসনসহ নানা পর্যায়ের মানুষের সুনজর পড়েছে গ্রামটির প্রতি। দেখন বর্মণ ও তাঁর মেয়ে অনিতা বর্মণ পেয়েছেন নতুন ঘর। সংস্কার করা হয়েছে খানাখন্দে ভরা সড়ক। এসেছে সড়কবাতি। আলো ছড়াচ্ছে আলপনা গ্রাম।