সদর দরজার ওপর ঝুঁকে আছে হলুদ চন্দ্রপ্রভা ফুলের ঝাড়। একপাশে শ্বেতকাঞ্চন, নয়নতারা, ফুটি টগরসহ নানা রকম পাতাবাহার গাছে সবুজ হয়ে আছে প্রবেশপথ। সদর পেরিয়ে মোজাইকের সিঁড়ি। সেটা বেয়ে আমরা সোজা পৌঁছালাম চারতলা বাড়ির ছাদে। দরজা খুলতেই মিষ্টি হাওয়ার সঙ্গে নাকে ভেসে এল বেলি ফুলের সুবাস। ছাদজুড়েই পরিপাটি বাগান। কয়েক রকমের জবা, দুপুরমণি, মধুমঞ্জরী, রঙ্গন, ঘাসফুল, কলাবতীসহ হরেক রকম ফুল ফুটে আছে। কিন্তু সাধারণত শখের বাগানে যে ধরনের ফুলের গাছ দেখা যায়, তেমন ফুল নেই, সবই বুনো বা জংলি।

গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম নগরীর হিলভিউ আবাসিক এলাকায় স্থপতি আলা ইমরান ও আশিক ইমরান দম্পতির শখের ছাদবাগান দেখতে। বিকেলের রোদ তখন ঘন হয়ে উঠেছে। বাগানজুড়ে অনাদরের জংলি গাছপালার এত সমাদর দেখে কিছুটা অবাকই হতে হলো।

এমন সব গাছ লাগানো, যেগুলোর বেশি যত্ন নিতে হয় না
ছবি: সৌরভ দাশ

জংলি গাছপালা দিয়ে বাগান করার কারণ জানালেন আলা ইমরান। বললেন, ‘আমরা সবাই সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকি। করোনার বন্ধে যখন ছাদবাগান করার কথা মনে হলো, তখন থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল, এমন সব গাছ লাগানো, যাদের বেশি যত্ন নিতে হবে না। শৌখিন গাছপালা দুর্বল হয়, একটুতেই মরে যায়। তাই আমরা ছাদবাগানে এমন গাছ লাগিয়েছি, যাদের প্রাণশক্তি ভালো, টিকে থাকবে। আমার স্বামীরও নানা রকম জংলি পাতাবাহার পছন্দ। যখন যেখানে যাই, সেখানকার ঝোপজঙ্গলে যেটা দেখতে ভালো লাগে, তা নিয়ে আসি। গ্রাম থেকেও অনেক গাছ এনেছি। এই বাগানের অধিকাংশ গাছই এভাবে সংগ্রহ করা।’

চারদিকে বুনো ঝোপ আর জংলি লতার কারণে বর্ষাকালে বাগানটা আরও সবুজ হয়ে ওঠে।
ছবি: সৌরভ দাশ

ছাদবাগান ঘুরে তাঁর কথার চাক্ষুষ প্রমাণও মিলল। ছাদের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে লোহার চারকোনা ফ্রেম। ফ্রেমের চারদিকে অপরাজিতা, গুলঞ্চ, পানসহ বুনো লতাজাতীয় গাছপালা দিয়ে সবুজ দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। মাথার ওপর টিনের ছাউনি। নিচে কাচের টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার। বৃষ্টি উপভোগের চমৎকার ব্যবস্থা। এক কোণে সিমেন্টের বড় গামলায় পদ্মপাতার দেখাও মিলল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের সব দেখাচ্ছিলেন আলা ইমরান।

এক ফাঁকে মুঠোফোনে আশিক ইমরানের সঙ্গে কথা হলো। বললেন, ‘রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে বাগানে এসে বসি। এখন তো বাড়িতে অতিথি এলে কেউ আর ঘরে বসতে চান না। সবাই ছাদে চলে আসেন। চারদিকে বুনো ঝোপ আর জংলি লতার কারণে বর্ষাকালে বাগানটা আরও সবুজ হয়ে ওঠে। আর সারা বছরই কোনো না কোনো ফুল ফুটতে থাকে। এমন একটা বাগানই আমরা চেয়েছিলাম, যা রোদ–ঝড়–বৃষ্টিতে টিকে থাকতে পারে আর বাগানের পেছনে বেশি সময়ও যেন না দিতে হয়।’

তাঁদের বাগান যে আপন শক্তিতেই টিকে আছে, দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল। কয়েক দিন আগের ঘূর্ণিঝড় বা কালবৈশাখীর কোনো চিহ্নই বাগানে নেই। একজন বয়স্ক মালীর সঙ্গে মিলে আলা ইমরান গাছে পানি দিচ্ছিলেন। কোনোটির ডালপালা ছেঁটে দিচ্ছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে শোনাচ্ছিলেন বাগান করার গল্প।

এমন একটা বাগান চেয়েছিলেন, যা রোদ–ঝড়–বৃষ্টিতে টিকে থাকতে পারে, আর বাগানের পেছনে বেশি সময়ও যেন না দিতে হয়।
ছবি: সৌরভ দাশ

টিনের ছাউনির সামনে বিকেলের রোদ তখন ডান দিকে হেলে পড়েছে। সেখানে দড়ির খাড়া মাচা ছেয়ে আছে হলুদ সিঙ্গাপুর ডেইজিতে। তার পাশেই চোখে পড়বে কলাগাছ, বাঁশপাতার ঝাড়, নেপিয়ার ঘাস, দূর্বাঘাসে ঘেরা একটি কৃত্রিম জলাশয়। জলের ওপর মাথা তুলে আছে ছোট ছোট পানা আর জলজ গুল্ম। একপাশে জলের ওপর নুয়ে আছে কাশফুলের ঘাস। পাশেই সন্ধ্যামালতীর ঝোপ।

আলা ইমরান জানালেন, তাঁর ছেলের মাছের শখ। আগে ঘরে অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ রাখতেন। ছাদবাগান করার পর ছেলের পছন্দমতো কংক্রিট দিয়ে বাঁধিয়ে মাছের জন্য এই জায়গা করা হয়েছে। এখানে কই, সাকার মাছসহ নানা রকম রঙিন মাছ ছাড়া আছে। তাঁদের ছোট মেয়ে প্রায়ই এই জলাশয়ের পাশে বসেই ছবি আঁকে।

আছে ফুলের গাছও
ছবি: সৌরভ দাশ

ঝরঝরে বাংলায় নিজের ছাদবাগানের গল্প যিনি শোনাচ্ছেন, তিনি নিজে কিন্তু বাংলাদেশি নন। আলা ইমরানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাশিয়ার বেলারুশে। নব্বইয়ের দশকে সেখানে পড়াশোনা করতে যাওয়া বাংলাদেশি স্থপতি আশিক ইমরানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। পরে ১৯৯৪ সালে তাঁরা বাংলাদেশে আসেন।

সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে আলা ইমরান বলেন, ‘আমি যখন প্রথম বাংলাদেশে আসি, তখন ফেব্রুয়ারির শীত। আমাদের দেশে এই সময় চারদিক বরফে ঢাকা থাকে। এখানে এসে অবাক হয়ে দেখলাম সবকিছু রঙিন আর উজ্জ্বল। এত ফুল দেখে উৎসবের মতো মনে হচ্ছিল। এয়ারপোর্টে আমাদের বরণ করতে সবাই লম্বা একধরনের সাদা ফুল নিয়ে এসেছিলেন। কী যে সুন্দর গন্ধ! পরে জানলাম ওটার নাম রজনীগন্ধা। সেই থেকে আমার রজনীগন্ধা পছন্দ। কিন্তু এখন আর রজনীগন্ধায় তেমন গন্ধ হয় না। আমার বোগেনভিলিয়া (বাগানবিলাস) ফুলও খুব পছন্দ। ছাদবাগানে তিন রঙের বোগেনভিলিয়া লাগিয়েছি। বাংলাদেশের মাটি, আবহাওয়া এত ভালো, এখানে সব গাছপালাই তরতাজা হয়।’

বাগানে বেশ কিছু দেশি–বিদেশি ফলের গাছ আর ক্যাকটাসও দেখা গেল। বড় বড় প্লাস্টিকের টব ও টিনের ড্রামে লাগানো হয়েছে ড্রাগন ফল, আম, লেবু, আতা, সফেদা, আমড়া, পেয়ারাসহ নানা রকম ফলের গাছ।

ফল গাছ নিয়ে মজা করে আলা ইমরান বললেন, ‘আমার শাশুড়ির ফল গাছের শখ। ফল, ফুলের এত গাছ চোখের সামনে আমি তো কখনো দেখিনি। আনারস খেতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আগে ভাবতাম নারকেলগাছের মতো বড় গাছে আনারস হয়। বাংলাদেশে এসে আমার শাশুড়ির বাগানে প্রথম মাটিতে আনারসের গাছ দেখে জানলাম আনারসগাছ কেমন। ছাদবাগানে সব ফলের গাছও তাঁর ইচ্ছাতেই লাগানো।’

এই বাগানে অনেকটা সময় কাটান আলা ইমরান ও আশিক ইমরান দম্পতি
ছবি: সৌরভ দাশ

আলা ইমরান ও আশিক ইমরান দম্পতি চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছেন স্থাপত্য ফার্ম ফিয়ালকা। বড় ছেলে আরিক ইমরান উচ্চশিক্ষার্থে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। মেয়ে আমরিন ইমরানও স্থপতি।

এরই মধ্যে ইমরান দম্পতির ছাদবাগানের গল্প অনেকেই জেনে গেছেন। অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটরও ভিডিও করেছেন এই ছাদবাগান। বছরের বিভিন্ন সময়ে এই ছাদের চেহারাও পাল্টে যায়। ভরা বর্ষার সময়ে পুরো ছাদ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গাছগুলো দেখলে যে কেউ সেটা বুঝবেন।

আরও পড়ুন

ছাদবাগানের সবজি