ঈদে ঘর সাজাবেন যেভাবে
পেশায় একজন স্থপতি ও আলোকচিত্রী ফওজিয়া জাহান। ঘর সাজানো তাঁর অনেকগুলো শখের মধ্যে একটি। প্রতিবছর ঈদের আগে নিজের জন্য নতুন পোশাক কেনার আগে অন্দরের জন্য কেনাকাটা করেন ফওজিয়া জাহান।
অন্দরকে মনের মতো করে সাজানোর এমন শখ ফওজিয়া জাহানের মতো অনেকেরই আছে। বিশেষ করে ঈদের দিনকে ঘিরে ঘর সাজানোর এ আয়োজনের পরিধিও হয় বড়।
ছোটবেলার ঈদের কথা ভাবলে কিন্তু পরিপাটি ও গোছানো অন্দরের কথাই মনে হবে। যদিও সে সময় গৃহসজ্জার মধ্যে ছিল ঘর পরিষ্কার করা, আলমারি থেকে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ ছড়ানো পরিষ্কার বিছানার চাদর বিছানো। পর্দা, সোফার কভার ও কুশন বদলানো। তবে আধুনিক সময়ের অন্দরসজ্জায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন ভাবনা। অন্দরের বেশভূষা সুন্দর করতে প্রকাশ পায় আরও বেশি শৌখিনতা।
বিখ্যাত অন্দরসজ্জাবিদ ডেভিড হিকস মনে করেন, ‘একটি অন্দরের সাজসজ্জাই বলে দেয়, সে ঘরে কারা বাস করেন।’ তাই ঘর সাজাতে নিজের রুচি ও পছন্দকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। ঘরের সাজের একঘেয়েমি দূর করার বড় সুযোগ পাওয়া যায় ঈদের সময়। তবে এলোমেলোভাবে নয়; বরং প্রয়োজন অনুসারে তালিকা করে ধাপে ধাপে সাজাতে হবে ঘর।
আসবাব
ঈদের সময় ঘরের জন্য চাইলে নতুন আসবাব কেনা যায় আবার পুরোনো আসবাবকে নতুন রূপ দেওয়া যায়। পেইন্ট করে আসবাবে নতুন ভাব আনা যায়। এ ছাড়া ঘরে নতুনত্ব আনতে আসবাবের জায়গা পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ। যে সোফা এত দিন ডান দিকে ছিল, সেটাকে এবার বদলে নিতে পারেন বাঁয়ে। একা পড়ে থাকা ডিভানটা হয়তো সোফার সঙ্গে মিলিয়ে বসালেন।
ঈদের দিনে ঘর সাজাতে অনেকেই নতুন ডিভান, দোলনা, আঁকা টুল, রকিং চেয়ার, ছোট টেবিলের মতো শৌখিন আসবাবে ঘর সাজান। নতুন আসবাবে ঘরের পরিবেশে আসে পরিবর্তন। নতুন সংসার হলে তো চিন্তা নেই। তবে ঘরজুড়ে আসবাব থাকলে সেটা ভালো দেখাবে না। বরং ঘরে যতটা সম্ভব খোলামেলা পরিবেশ বজায় রাখুন। ঈদের দিনে আসবাবে পুরোনো ভাব থাকলে কি আর চলে! নতুন আসবাব কিনতে না চাইলে পুরোনো আসবাবে বার্নিশ করে নতুন রূপ দিতে পারেন। চকচকে আসবাবে ঘরজুড়ে উৎসবের আমেজ আসবে।
বিছানার চাদর
সুন্দর বিছানার চাদর কিন্তু পুরো ঘরের চেহারাই বদলে দিতে পারে। যদিও উৎসবের আমেজ ও ঘরের ধরন বুঝেই বিছানার চাদর বিছাতে হবে। বিছানায় হালকা ও চোখের আরাম দেবে, এমন রঙের চাদর ভালো লাগবে। আবার গাঢ় রং ব্যবহারে আসে উৎসবের ভাব। তাই বসার ঘরে ডিভানে উজ্জ্বল রঙের চাদর মন্দ লাগবে না। খুব চকমকে জমিনের চাদর ব্যবহার না করে ঈদের দিনে কেপ সিল্কের প্যাচওয়ার্ক চাদর ডিভানে ভালো লাগবে। শিয়ার আর্টিস্ট্রি, খুঁত, আড়ং, যাত্রাসহ বেশ কিছু অনলাইন পেজ ও দোকানে পাওয়া যাবে এমন প্যাচওয়ার্কের চাদর।
ঈদের দিনে শোবার ঘরের জন্য সাদা বা প্যাস্টেল শেডের সুতি ব্লক প্রিন্টের চাদর দেবে প্রশান্তি। বিছানার সৌন্দর্য বাড়াতে চাদরের সঙ্গে মিলিয়ে ছোট ছোট কুশন রাখতে পারেন পাশে।
সোফার গদি কভার, কুশন ও পর্দা
ঈদের দিনে অতিথিরা অন্য ঘরের তুলনায় বসার ঘরেই বেশি সময় থাকেন। তাই অন্দরসজ্জায় বসার ঘরকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বসার ঘর উজ্জ্বল ও হালকা রঙের মিশেলে সাজাতে পারেন। অন্দরসজ্জাবিদ গুলশান নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘সোফার গদির রং হালকা হলে কুশন কভারের রং গাঢ় নিতে পারেন। সিকুইনের কুশনের ধারাও এখন বেশ চলছে। ঈদের থিমেও সোফা ও ডিভান সাজানো যায়। চাঁদ, তারকা বা মিনারের ডিজাইন করা কুশন কভার পাওয়া যাবে বিভিন্ন ঘরের সব পর্দা একই রকম না করে কয়েকটি প্যাস্টেল শেড মিলিয়ে সাজাতে পারেন। এতে নরম ও কোমল ভাব আসবে।’
শতরঞ্জি ও কার্পেট
বসার ঘরের আকার বুঝে ছোট বা বড় আকারের শতরঞ্জি ও কার্পেট বিছিয়ে নিলে ঘরের আভিজাত্য বাড়বে। শতরঞ্জিতে দেশি আসব ফুটিয়ে তোলা সহজ। আর রাজকীয় আমেজ আনতে চাইলে কার্পেটই আদর্শ। ইরানি নকশার কার্পেট অনেকেই ঈদের দিনের জন্য পছন্দ করেন। পাটের তৈরি শতরঞ্জির দেখা মিলবে অনেক প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকেও বেছে নেওয়া যেতে পারে ঈদের অনুষঙ্গ।
টেবিল রানার ও ম্যাট
ঈদের দিনে খাবার টেবিলের সাজ পায় বিশেষ গুরুত্ব। মজার মজার খাবার সাজানো হবে যে টেবিলে, সেটারও সাজসজ্জা হওয়া চাই উৎসব উপযোগী। টেবিল সাজানোর অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে টেবিল রানার ও ম্যাটকেই প্রাধান্য দিতে হবে। টেবিলে একটু উজ্জ্বল ও গাঢ় রঙের ম্যাট ও রানার সুন্দর লাগবে। আধুনিক লুক আনতে জ্যাকার্ড পাড় কাটা টেবিল ম্যাট ও রানারে আসবে বৈচিত্র্য। জ্যামিতিক, ফুলেল, স্ট্রাইপ প্যাটার্নগুলো ব্যবহৃত হয় জ্যাকার্ড নকশায়। হোম স্টাফ পেজে পাওয়া যাবে এ ধরনের টেবিল ম্যাট ও রানার। টেবিল ক্লথ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সাদা রঙের পরিবর্তে উষ্ণ রং বেছে নিতে পারেন।
মোম ও আলোকসজ্জা
ঈদের দিন ঘর থাকতে হবে সুবাসিত। তাই ফুল রাখেন অনেকে। এ ছাড়া সুগন্ধি মোম দিয়েও এই আবহ তৈরি করা যায়। সাধারণ মোমের বদলে এখন নানা রকম ডিজাইন ও আকারের মোমই বেশি ব্যবহার করা হয়। ঘ্রাণ হয় ভিন্ন ভিন্ন। এ ছাড়া চাঁদ ও তারা আকারের ফেইরি লাইট জানালার সঙ্গে টাঙিয়ে দেওয়া যায়। ছোট ইরানি ঝাড়বাতি বা টার্কিশ লাইট দিয়ে বসার ঘর বা খাবার ঘর সাজাতে পারেন। বাজেট কম হলে হ্যান্ডপেইন্ট করা লাইট ও বাঁশ দিয়ে তৈরি টেবিল ল্যাম্পে ঘরের আবহ পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন অন্দরসজ্জা প্রতিষ্ঠান চতুষ্কোণের পরিচালক কান্তা কবির।
গোছানো রান্নাঘর
একসময় রান্নাঘরকে মূল ঘরের বাইরের অংশই মনে করা হতো। তবে আধুনিক রান্নাঘরের ধারণাটি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় শোবার ঘর, বসার ঘরের মতো রান্নাঘরের সাজসজ্জাও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। রান্নাঘরে অন্যান্য ঘরের তুলনায় অনেক বেশি পণ্য থাকে। তাই গুছিয়ে রাখাটাও বেশ কঠিন। হাতিলের পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, ‘ঈদের সময়ে রান্নাঘর সাজিয়ে–গুছিয়ে রাখতে ক্যাবিনেট সবচেয়ে ভালো সমাধান। এ ছাড়া রান্নাঘরের অব্যবহৃত কর্নারের মাপ অনুসারে ফরমাশ দিয়ে চেম্বার বা ক্যাবিনেট তৈরি করে নেওয়া যায়।’
প্লেট, চামচ, চায়ের কাপ গুছিয়ে রাখতে ধাতবের র৵াক পাওয়া যায়। ঈদের দিন রান্নার মসলা রাখতে দেয়ালে ছোট ছোট র৵াকে কৌটা সাজিয়ে রাখতে পারেন। বাজারে এ ধরনের র৵াক সহজেই পেয়ে যাবেন। রান্নাঘর গুছিয়ে রাখতে রোলিং কার্ড বা চাকা দেওয়া কার্ডও কিনতে পারেন। এখানে রান্নার সামগ্রী রেখে ইচ্ছেমতো সারিতে রাখতে পারবেন। ঈদের দিনে গাছ দিয়ে সাজাতে পারেন রান্নাঘর। সে ক্ষেত্রে দেয়ালে কাঠের ছোট ছোট তাক করতে পারেন বা বাজার থেকে কেনা মেটালের তাকেও গাছের ছোট টপ বা পাত্র রাখা যায়।
চাঁদরাতেই রান্নাঘর পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখুন। সকালে উঠে যাতে কোনো জিনিস খুঁজে পেতে অসুবিধা না হয়।
পরিবেশনের পাত্রগুলো ক্যাবিনেটে রাখলে কোন বাসনে কী খাবার বাড়বেন, সেটা বুঝে সামনের দিকে রাখুন। রান্নাঘরের ছুরি, কাঁচি, বঁটি, পাটার মতো জিনিসগুলো সাবধানে রাখা জরুরি।
ময়লা ফেলার জন্য বিনে আলাদা পলিথিন দিয়ে রাখুন, যাতে ভরে গেলে সহজে তুলে ফেলতে পারেন।