কীভাবে তৈরি হলো আজকের এবিসি রিয়েল এস্টেট
১৯৭২ সালে অ্যাসোসিয়েটেড বিল্ডার্স করপোরেশন (এবিসি) লিমিটেড নামে একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন আমীরুল ইসলাম ও তাঁর ভাই নজরুল ইসলাম; সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীসহ আরও দুজন। পরে সমান অংশীদারত্ব নিয়ে এই কোম্পানিতে যুক্ত হন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সুভাষ চন্দ্র ঘোষ ও স্থপতি মোস্তাকুর রহমান। ধীরে ধীরে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে এবিসি।
আশির দশকের শেষে ব্যবসা বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে আবাসন ব্যবসা শুরু করে এবিসি। একটি-দুটি করে আবাসন প্রকল্পও হতে থাকে। রেডিমিক্স কংক্রিট ও ফ্যাসিলিটি ম্যানেজমেন্ট সেবা নিয়ে আসে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান।
এবিসি গ্রুপের দীর্ঘ ৫২ বছরের এই রূপান্তর নিয়ে গত অক্টোবরের শেষ দিনে শুভংকর কর্মকার–এর সঙ্গে কথা বলেছেন এবিসি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এবিসি রিয়েল এস্টেটের পরিচালক সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। উপস্থিত ছিলেন তাঁর দুই সন্তান এবিসি রিয়েল এস্টেটের পরিচালক শ্রাবন্তী দত্ত ও সৌগত ঘোষ
পাঁচ দশকেও অটুট এবিসির বন্ধন
এই জুলাইয়ে ৮১ বছর পূর্ণ করেছেন এবিসি গ্রুপের অন্যতম উদ্যোক্তা সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। বয়সের ছাপ পড়েছে। তবে মনের দিক থেকে এখনো তরুণ। প্রতিদিন নিয়ম করে এক বেলা অফিস করেন। তেমনই এক সকালে বনানীতে তাঁর কার্যালয়ে আমরা হাজির হই। আগেই কথা ছিল, সুভাষ চন্দ্র ঘোষ ও তাঁর মেয়ে শ্রাবন্তী দত্তের সঙ্গে আমরা কথা বলব। তবে সেদিন ছেলে সৌগত ঘোষকেও পাওয়া গেল। শ্রাবন্তী ও সৌগত—দুজনই এখন এবিসি গ্রুপের আবাসন ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।
এবিসি শুরু করার আগে থেকেই বলতে থাকলেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৬৬ সালে অবাঙালি শামীম ইয়াকুবের মালিকানাধীন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ইয়াকুব লিমিটেডে যোগ দেন তিনি। পদ—সহকারী প্রকৌশলী। মাসে বেতন ৩৫০ টাকা। যোগ দিয়েই পঞ্চগড় চিনিকল নির্মাণ প্রকল্পে যেতে হলো তাঁকে। এর জন্য বাড়তি ৫০ টাকা বরাদ্দ ছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মতিঝিলে ইয়াকুব লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা করার দায়িত্ব পেলেন। সে সময় কোম্পানির হাতে থাকা বড় দুই প্রকল্প—রমনা ভবন ও জয়দেবপুর ডিজেল প্ল্যান্ট নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হলেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ।
স্বাধীনতার পর ইয়াকুব লিমিটেডের মালিক পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হলে একজন সহকর্মীকে নিয়ে কোম্পানি পরিচালনার পাশাপাশি অসম্পূর্ণ প্রকল্প শেষ করার চেষ্টা করলেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। তবে আর্থিক সংকটে কর্মীদের বেতন–ভাতা দেওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছিল। সে সময় দেশত্যাগী অবাঙালিদের কোম্পানি দেখভালে সরকার একজন যুগ্ম সচিবকে প্রশাসক নিয়োগ করে। শান্তিনগরে প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে যেতে হতো সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। সেখানে ভিড় করতেন আরও অনেক কোম্পানির পদস্থ কর্মকর্তারা।
স্মৃতির বাক্স খুলে বসেছেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। ধীরস্থিরভাবে বলে চলেন একের পর এক ঘটনা। বললেন, ‘প্রশাসক সাহেবের দেখা পেতে দু–তিন ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। সে কারণে ওয়েটিং রুমে অনেকের সঙ্গে আলাপ হতো। সেখানেই ডেল্টা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক আমীরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়। আর্থিক সংকটে তখন ডেল্টার অবস্থা শোচনীয় বলে আমীরুল ইসলাম কোম্পানির দায়ভার সরকারের কাছে বুঝিয়ে দিতে চাইছিলেন। আলাপে আলাপে ধীরে ধীরে আমাদের দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়তে থাকল। যদিও আমাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল প্রায় ১৫ বছর।’
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘আমীরুল ইসলামের কাছেই জানলাম যে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনি তাঁর এক সিনিয়র বন্ধু সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ভাই নজরুল ইসলাম এবং আরও দুজনকে নিয়ে একটি নির্মাণ কোম্পানি শুরু করেছেন। সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী হলেন চেয়ারম্যান। তিনিই কোম্পানির নাম করেন অ্যাসোসিয়েটেড বিল্ডার্স করপোরেশন লিমিটেড; সংক্ষেপে এবিসি।’
সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও আমীরুল ইসলাম—দুজনই শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক। বিভিন্ন চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তবু নতুন এই কোম্পানির যন্ত্রপাতি ও দক্ষ কর্মীর অভাব এবং নির্মাণকাজের পূর্ব অভিজ্ঞতার রেকর্ড না থাকায় বড় কাজের দরপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারছিল না এবিসি। অন্যদিকে ইয়াকুব লিমিটেড তত দিনে অসম্পূর্ণ কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী ও যন্ত্রপাতি থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও সরকারের বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে ভুগছিল প্রতিষ্ঠানটি। এমন প্রেক্ষাপটে আমীরুল ইসলাম ও সুভাষ চন্দ্র ঘোষ আলোচনা করে ইয়াকুব লিমিটেড–অ্যাসোসিয়েটেড বিল্ডার্স করপোরেশন লি. নামে একটি যৌথ উদ্যোগ বা কনসোর্টিয়াম গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। সময়টা ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি।
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘কনসোর্টিয়াম গঠনের পরপরই জয়দেবপুরের বাংলাদেশ মেশিন টুলস কারখানার ফাউন্ড্রি–১ ভবনের নির্মাণকাজ পেলাম আমরা। দুই কোটি টাকার কাজ। কিছুদিন পর ঢাকার কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের পাইলিংয়ের কাজও পেলাম আমরা। কাজ দুটির মাধ্যমে এবিসির ভিত শক্ত হলো। একাই এরপর নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিতে শুরু করল এবিসি। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
কাজ বাড়তে থাকায় এবিসির উদ্যোক্তারা চাপ সামলে উঠতে পারছিলেন না। একদিন আমীরুল ইসলাম নিজেই সুভাষ চন্দ্র ঘোষকে এবিসিতে উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। সুভাষ চন্দ্র ঘোষও রাজি হলেন। তখন এবিসির কার্যালয় ছিল ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে, সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বাড়ির নিচতলায় দু-তিনটি ঘর নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো, সুভাষসহ চার উদ্যোক্তার মধ্যে সমান হারে কোম্পানির শেয়ার বণ্টন হবে। হিসাব–নিকাশের পর কোম্পানির আর্থিক মূল্য দাঁড়াল ছয় লাখ টাকা।
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘আমাকে ২৫ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আমার ভাগের মূল্য দেড় লাখ টাকা। কিন্তু অত টাকা আমার কাছে ছিল না। উদ্যোক্তাদের কথাটা বললাম। তাঁরা জানালেন, এখনই দিতে হবে না। পরবর্তী সময়ে মুনাফার ভাগ থেকে সমন্বয় করে নেওয়া হবে। এভাবেই এবিসির সঙ্গে যুক্ত হলাম।’
ধীরে ধীরে এবিসির কাজের সংখ্যা বাড়তে লাগল। সুভাষ ঘোষের সহপাঠী চৌধুরী মো. শফি ও স্থপতি মোস্তাকুর রহমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘স্টোন স্টিল’ এবিসির একাধিক প্রকল্পে সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করত। এভাবেই মোস্তাকুর রহমানের সঙ্গে এবিসি পরিচালকদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে মোস্তাকুর রহমান এবিসিতে পরিচালক হিসেবে যুক্ত হলেন। তখন আবার পাঁচ পরিচালকের মধ্যে সমান হারে শেয়ার বণ্টন হলো।
একপর্যায়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ কোম্পানিতে পরিণত হলো এবিসি, যার মূল ভিত বিশ্বাসযোগ্যতা, চ্যালেঞ্জিং কাজের প্রতি আগ্রহ ও পরিশ্রম—কথাগুলো বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় সততার সঙ্গে কাজ করেছি। কখনোই অনিয়মের পথে যাইনি। উন্নতি ও দীর্ঘ সময় ব্যবসা করার লক্ষ্যে কাজ করেছি। কখনোই উচ্চাশা বা কুইক রিটার্নের লোভে পড়িনি। অভিজ্ঞতা ও সুনামের কারণেই আমরা একের পর এক বড় প্রকল্প পেয়েছি।’
পাঁচ দশকের যাত্রায় সরকারি–বেসরকারি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ করেছে এবিসি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশুগঞ্জ সার কারখানা, গাজীপুরে বাংলাদেশ মেশিন টুলস কারখানা, ঘোড়াশাল ২১০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র (চতুর্থ ও পঞ্চম ইউনিট), পলাশ সার কারখানা, গড়াই ব্রিজ, এসএমসি টাওয়ার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ও ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন হাসপাতাল, ন্যাম ফ্ল্যাটের দুটি ১০ তলা ভবন।
এ ছাড়া স্কয়ার গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, বার্জার, শাহ সিমেন্ট, বিএসআরএম, কেএসআরএম গ্রুপের কারখানার পাশাপাশি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিইউএফটি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক ক্যাম্পাস নির্মাণে এবিসি কাজ করেছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজে নিযুক্ত বাংলাদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এবিসিও আছে।
আবাসন ব্যবসায় এবিসি
নির্মাণ খাতে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার পর ব্যবসা বহুমুখীকরণের চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবিসির উদ্যোক্তারা। আশির দশকে তখন মাত্র তৈরি পোশাকশিল্প গড়ে উঠছে। এবিসির উদ্যোক্তারা তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৮৫ সালে মিরপুরে গড়ে তোলা হয় বঙ্গ গার্মেন্টস। তবে এ ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারায় একপর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে আসে এবিসি। এটি চলে যায় কয়েকজন উদ্যোক্তার ব্যক্তিমালিকানায়। এখনো কারখানাটি সচল। তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। এটির চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর ছেলে রাশেদ চৌধুরী।
আশির দশকের শেষের দিকে আবাসন খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন এবিসির পাঁচ উদ্যোক্তা। ১৯৮৮ সালে এবিসি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠা হয়। নতুন এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সহপাঠী চৌধুরী মোহাম্মদ শফিককে নিয়োগ দেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। প্রথমে কলাবাগান ও তারপর বনানীতে শুরু হলো আবাসন প্রকল্প।
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘দেশের আবাসন খাতের শুরুর দিকে কোম্পানিগুলোর একটি হয়েও এবিসি রিয়েল এস্টেট খুব ভালো করতে পারছিল না। অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। তার বড় কারণ, আমরা পরিচালকেরা সে সময় নির্মাণ খাতের বড় বড় প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। তবে আমাদের বিশ্বাস ছিল, খাতটি সম্ভাবনাময়।’
নব্বইয়ের দশকের শেষে এবিসি রিয়েল এস্টেটে যুক্ত হয় দ্বিতীয় প্রজন্ম। প্রথমে নজরুল ইসলামের ছেলে নাশিদ ইসলাম যোগ দেন। পড়াশোনা শেষ করে শ্রাবন্তীও এলেন, ২০০২ সালে। তার পর থেকেই এবিসির আবাসন ব্যবসার পরিধি বাড়ে।
এ পর্যায়ে এবিসি রিয়েল এস্টেটের পরিচালক শ্রাবন্তী দত্ত বললেন, নব্বইয়ের দশকে আবাসন খাত খুবই চ্যালেঞ্জিং সময় পার করেছে। তখন অধিকাংশ মানুষ ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করার চিন্তাও করতেন না। আবাসন প্রকল্প করার জন্য জমিও পাওয়া যেত না, এমনকি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের কোনো আইনও ছিল না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। সরকার যখন ফ্ল্যাট নিবন্ধনের নিয়মকানুনসহ আবাসন খাতে মনোযোগ দেওয়া শুরু করল, তখন অনেকের মধ্যে আস্থা তৈরি হলো।
তিন যুগের প্রতিষ্ঠান এবিসি রিয়েল এস্টেট ঢাকার উত্তরা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডি, মিরপুর, বসুন্ধরা, শ্যামলী ও মগবাজারে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন প্রকল্প করেছে। চট্টগ্রামেও প্রকল্প করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আবাসন প্রকল্পের পাশাপাশি বাণিজ্যিক প্রকল্পও করছে এবিসি। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৭০টি আবাসন প্রকল্পের ১ হাজার ৮৭৮টি অ্যাপার্টমেন্ট গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অধুনা মগবাজারে ইস্পাহানি কলোনির সাড়ে ১৪ বিঘা জমিতে দ্য ওয়েসিস নামে আন্তর্জাতিক মানের গেটেড কমিউনিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবিসি রিয়েল এস্টেট। প্রকল্পের ৫৮ শতাংশই খালি জায়গা। এটি এবিসি রিয়েল এস্টেটের আইকনিক প্রকল্প হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিত পেয়েছে। কোভিড মহামারি, নির্মাণসামগ্রীর আমদানি সংকট ইত্যাদি সত্ত্বেও রেকর্ড সময়ে ৪৫৭টি ফ্ল্যাটের এই বিশাল প্রকল্প সম্পন্ন করে এবিসি। ৯টি ভবনের ৮০ শতাংশ ফ্ল্যাটে বাসিন্দারা বসবাসও শুরু করেছেন।
প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে এবিসি রিয়েল এস্টেট খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে বলে জানালেন শ্রাবন্তী দত্ত। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে সুনামটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একসঙ্গে যতগুলো প্রকল্প ঠিকঠাকভাবে ম্যানেজ করতে পারব, ততগুলোই নিয়ে থাকি। সে কারণে আমাদের হাতে একসঙ্গে অনেক প্রকল্প থাকে না। আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রে জমি নেওয়া থেকে গ্রাহকদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া পর্যন্ত স্বচ্ছতা, নাগরিক সুযোগ–সুবিধা রয়েছে—এমন এলাকার জমি নির্বাচন, আধুনিক নকশা, মানসম্মত উপকরণে নির্মাণকাজ ও সময়মতো প্রকল্প হস্তান্তরে বেশি জোর দিই। আমাদের ভবনের কাঠামো বৈশ্বিক মানের। ফ্ল্যাটের ভেতরের নকশায় ব্যবহারযোগ্য জায়গা আর কার্যকারিতা বাড়াতেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যাতে বসবাস আরামদায়ক হয়।’
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে শ্রাবন্তী দত্ত বলেন, ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারছি যে ছোট ছোট জমিতে ভালো মানের আবাসন প্রকল্প করা খুবই কঠিন। তবে বাস্তবতা হলো এই শহরে ছোট আয়তনের জমিই বেশি। তাই ব্যবসা চালিয়ে নিতে আমরা মাঝারি আবাসন প্রকল্প করে যাব, তবে আমরা বড় প্রকল্প নেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ দেব। কারণ, বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নাগরিকদের বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা দেওয়া সম্ভব। আমরা এখন ঢাকা এবং এর আশপাশে বৃহৎ প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা করছি।’ তিনি জানান, এবিসি বর্তমানে মগবাজারে দ্য অরচার্ড অ্যাট ইস্পাহানি কলোনি নামে ১৪৩টি ফ্ল্যাটের একটি অভিজাত আবাসন প্রকল্পের কাজ করছে।
নেতৃত্বে দ্বিতীয় প্রজন্ম
পাবনার সুজানগর উপজেলার হাসামপুর গ্রামে সুভাষ চন্দ্র ঘোষের জন্ম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। খলিলপুর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর পাবনায় লজিং থেকে বনমালী টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। পাস করে সোজা ঢাকায়। ভর্তি হলেন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এ সময় খরচ চালাতে টিউশনিও করতে হয়েছে সুভাষ চন্দ্র ঘোষকে।
ব্যবসায়ী হবেন, এমন চিন্তাভাবনা কি ছোটবেলায় ছিল—এ প্রশ্নের জবাবে সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘আমাদের পরিবারটা বিরাট। অনেকগুলো ভাইবোন। তাই চাকরি করে সংসার চালানো আমার পক্ষে সম্ভব না। ফলে আগে–পরে আমাকে ব্যবসা করতে হবে, এমন চিন্তাভাবনা ছিল।’
নির্মাণ ও আবাসন ছাড়া এবিসি গ্রুপের বর্তমানে এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টস ও এবিসি ফ্যাসিলিটিস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। গ্রুপের কর্মিসংখ্যা প্রায় এক হাজার।
এবিসি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং পরিচালক আমীরুল ইসলাম প্রয়াত হয়েছেন, অবসরে গেছেন নজরুল ইসলাম। বর্তমানে এবিসি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। এবিসি রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন মোস্তাকুর রহমান। সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর ছেলে রাশেদ এ চৌধুরী বর্তমানে এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টস ও এবিসি ফ্যাসিলিটিসের চেয়ারম্যান। নজরুল ইসলামের ছেলে প্রকৌশলী নাশিদ ইসলাম এবিসি লিমিটেডের দেখভাল করছেন। আর আবাসন ব্যবসা দেখছেন শ্রাবন্তী দত্ত ও সৌগত ঘোষ।
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, এবিসি গ্রুপে দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে ব্যবসার নেতৃত্ব হস্তান্তর খুবই ধীরস্থির ও পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। শ্রাবন্তী ও সৌগতর মতো দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন, কেউ কেউ এখনো করছেন। প্রথম প্রজন্ম যখন তাঁদের যোগ্য মনে করেছে, তখনই তাঁরা পরিচালক পদে নেতৃত্বে এসেছেন।
শ্রাবন্তী দত্ত জানান, প্রায় ১১ বছর চাকরি করার পর তিনি পরিচালক পদ পেয়েছেন। এই ব্যবসার খুঁটিনাটি সিনিয়র সহকর্মীদের কাছ থেকে শিখে শিখেই এ পর্যায়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। বাংলাদেশের বেসরকারি মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানে পরিচালকদের নিজস্ব তত্ত্বাবধান, পরিশ্রম এবং কর্মিবান্ধব মানসিকতা ছাড়া দীর্ঘ সময় প্রাতিষ্ঠানিক সুস্থ প্রবৃদ্ধি ও সুনাম ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
এ পর্যায়ে সৌগত ঘোষ বললেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই ব্যবসায়ী বাবাকে দেখে বড় হয়েছি। তারপর পড়াশোনা শেষ করে ২০০৯ সালে যখন যুক্ত হলাম, তখন অফিসে বসিয়ে না রেখে আমাকে পাঠানো হয় সাইটে, সরাসরি নির্মাণকাজে। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ শিখেছি। সে কারণে কোম্পানির সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আমাদের ভেতরে গেঁথে গেছে। আমি যদি এসেই পরিচালক পদে বসে পড়তাম, তাহলে কোম্পানি ও তার দীর্ঘ সময়ের সহযোগী কর্মী দলের সঙ্গে সংযোগটা দৃঢ় হতো না।’
বাংলাদেশে গত শতাব্দীতে শুরু হওয়া অনেক যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসায় ভাঙন ধরেছে। এ ক্ষেত্রে এবিসি গ্রুপ ব্যতিক্রম। শুরুর দিকের পাঁচজনের মধ্যে দুজন প্রয়াত হলেও প্রজন্মান্তরেও অটুট আছে এই পার্টনারশিপ।
পাঁচ দশক ধরে টিকে থাকা এই বন্ধনের মূলমন্ত্র কী, জানতে চাইলে সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘প্রতারণা, আর্থিক অসততা ও অনেক সময় ব্যক্তিগত ঈর্ষার কারণে যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসা টিকছে না। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সততা ও একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাই এত বছর একসঙ্গে থাকার পেছনে কাজ করেছে। স্বচ্ছতাও আমাদের আরেকটা শক্তি। প্রতিটি হিসাব, প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা স্বচ্ছভাবে করেছি। প্রথম প্রজন্মের জীবদ্দশায় পরবর্তী প্রজন্মের প্রদর্শিত দক্ষতা, শক্তি ও আগ্রহের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে মালিকানা ও দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।’
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ ব্যবসার ফাঁকে লেখালেখিও করেন। লিখেছেন তিন দুয়ারের কোলে নামের আত্মজীবনী। তাঁর ৮০তম জন্মদিনে ইউপিএল প্রকাশ করেছে বাংলার ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণী গ্রন্থ বিভেদবয়ান। তিন বছর আগে পাবনায় পৈতৃক ভিটায় নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন মেয়েদের জন্য অবৈতনিক উচ্চবিদ্যালয়। নাম সুধীর ঘোষ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘জীবন নিয়ে আমি স্যাটিসফায়েড (সন্তুষ্ট)। যখন যেটি করার প্রয়াস ও পরিকল্পনা নিয়েছি, তখন সেটি সার্থকভাবে করতে পেরেছি। এখনো আমি কাজ পছন্দ করি। সব দায়িত্ব তরুণ প্রজন্ম বুঝে নিলেও অভিভাবক হিসেবে আমি তাদের সঙ্গে আছি। আমৃত্যু এভাবেই তিলে তিলে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে চাই।’