বাংলাদেশের আরও অসংখ্য পণ্য জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য

‘রংপুরের শতরঞ্জি’র প্রতিষ্ঠাতা শফিকুল আলম সেলিমের এক-দুবার নয়, ‘জেলে থাকার সুযোগ হয়েছে’ সাতবার! তিনি নাকি ভালো ছাত্র ছিলেন না। ছাত্র আন্দোলন করে বেড়াতেন। জেলে থেকেই নাকি কাজ শিখেছিলেন। আর স্বপ্ন দেখাটা তাঁর স্বভাবের মধ্যেই ছিল। তাই কিছু করে খাওয়ার তাগিদ থেকেই রংপুরের বিখ্যাত শতরঞ্জির দোকান দিয়েছিলেন। আজ সেই প্রতিষ্ঠান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। সম্প্রতি পেয়েছে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশনের (জিআই) স্বীকৃতি। সেটি উদ্‌যাপন করতে গত ২৯ আগস্ট এক ছাদের নিচে মিলিত হয়েছিলেন দেশের শিল্প-সংস্কৃতির একঝাঁক চেনা মুখ ও গণমাধ্যমকর্মী।

রাজধানীর ধানমন্ডির শুক্রাবাদে ‘নন্দিনী’ নামে একটি পাঁচতলা ভবন। ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় কারুপণ্য। বিশেষ করে রংপুরের শতরঞ্জি। এ ছাড়া প্রথম তলায় রয়েছে কফি শপ। তৃতীয় ও চতুর্থ তলা অনেকটা হোটেলের মতো। সেখানে বিদেশ থেকে আগত ক্রেতাদের জন্য রয়েছে থাকার সুব্যবস্থা। পঞ্চম তলা রেস্তোরাঁ। সেখানে বিদেশি খাবারের পাশেই শোভা পাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরা সব খাবার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
শতরঞ্জির জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে সবার ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে শফিকুল আলম বলেন, ‘১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেবার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে গেলেন, সবাইকে উপহার দেওয়ার জন্য তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন রংপুরের এই ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি। তারপর ২০০২ সালে ছেলে সজীব ওয়াজেদের বিয়ের পর শতরঞ্জি পেতে তিনি বধূবরণ করেন। গণভবনে গেলে দেখবেন, সেখানেও রংপুরের শতরঞ্জি। আর গণমাধ্যম শুরু থেকেই শতরঞ্জির প্রচারণা চালিয়েছে। এই সবকিছুর ফলেই বাংলাদেশে এখন শতরঞ্জির প্রায় আড়াই শ কারখানা রয়েছে।’
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প খাতের ভেতর অন্যতম হলো হাতে বোনা শিল্প। আর এ শিল্পের একটি শতরঞ্জি। রংপুরের শতরঞ্জির জিআই প্রাপ্তির উদ্‌যাপন আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, বরেণ্য চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, কবি তরুণ ঘোষসহ আরও অনেকে। তাঁরা সবাই মনে করেন, বাংলাদেশে এমন আরও অনেক নিজস্ব পণ্য আছে, যেগুলো জিআই পাওয়ার যোগ্য। পাট, পাটজাত পণ্য, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, তুলা, তাঁতশিল্প, চা, রেশম, বাঁশ, খড়, ভুট্টার খোসা, খদ্দর, হোগলাপাতা, কচুরিপানা, নীল, জলপাতা, কাশিয়া, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া...আমাদের দেশ এ রকম সব নিজস্ব সম্পদ ও শিল্পে সমৃদ্ধ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
এখন পর্যন্ত ‘রংপুরের শতরঞ্জি’র রপ্তানিমূল্য ৩ কোটি ডলার বা ২৮৫ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৭ হাজার কর্মী। আর বাড়ি থেকে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেন ১২ হাজার কর্মী। এসব কর্মীর ৮৫ শতাংশ নারী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘আমি লন্ডন ও প্যারিস ঘুরেছি। এই দুটো শহর গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে “বাংলার অবদান”। ফরাসি আর ইংরেজদের শোষণ করা বাংলার অর্থ দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে এ দুই শহর। বাংলা সম্পদে–শিল্পে অনেক ধনী। সেই প্রাকৃতিক সম্পদ আর মানবসম্পদের সমন্বয় ঘটিয়ে শৈল্পিকভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ব্রিটিশরা সেই সময় বুঝেছিল, এটা সম্পদের দেশ; অথচ আমরা আজও বুঝতে পারছি না।’
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক জানান, তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিয়ের পর যত বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছেন, বেশির ভাগ সময় উপহার দিয়েছেন এসব বাহারি শতরঞ্জি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
রংপুরের শতরঞ্জি ছাড়াও সেখানে ছিল হোগলাপাতা, বাঁশ, কচুরিপানার ডাঁটা, কাশফুলের ডাঁটা, কাপড়, ফেলে দেওয়া ঝুট কাপড় প্রভৃতি উপাদানে তৈরি নানা কিছু। ফেলনা পলিথিন বা চিপসের প্যাকেটের সঙ্গে এসব উপাদানের সমন্বয়েও তৈরি হয়েছে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বিশেষ অতিথিদের বক্তব্যের পর ছিল দেশীয় সংগীত, প্রদীপ প্রজ্বালন আর দেশের নানা অঞ্চলের বিখ্যাত সব খাবারদাবার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন