ছাদে রঙিন প্রকৃতি

ফেসবুকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাড়ির ছাদের ছবি দেখে সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম। ছাদের এক পাশে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। পিৎজার টুকরা একটা একটা করে কমছিল। চিপসও পাত্র থেকে উধাও হচ্ছিল টপাটপ। সুরুৎ সুরুৎ শব্দ আসছিল চায়ে চুমুকের। আড্ডার বিষয় ছিল...নাহ্, আড্ডার আসলে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় ছিল না। একজন বলে উঠল, ‘আমি এসরাজ বাজাতে পারি। যখন কিছুই ভালো লাগে না, সংগীতের কাছে আত্মসমর্পণ করি।’

সাইকা ইকবালের সবুজ ছাদবাগান, শীতে একসঙ্গে অনেক গাছে ফুল ফুটলে তা হয়ে উঠবে রঙিন
ছবি: কবির হোসেন

আরেকজন সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, শিল্প মহৌষধ। সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। আমি তো নাচ, গান, আঁকা, লেখালেখি কিছুই শিখিনি। আমার কোনো যাওয়ার জায়গা নেই।’ তখনই সাইকা বলে উঠলেন, ‘আমি ওসব কিছুই পারি না। তবে আমার এই বাগানটায় এসে বসলে মন ভালো হয়ে যায়।’ হ্যাঁ, এই লেখার বিষয় আসলে এটাই। মেঘনার রঙিন ছাদ। পেশায় স্থপতি সাইকা ইকবাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক।

ছাদবাগান না বলে যেখানে আড্ডা চলছে, সেটাকে ‘ছাদ-উঠান’ বা এমন কিছু বলা যেতে পারে। মাথার ওপর ফল আর সবজির বাগান। নিচে মূলত ফুলের বাগান। বড় বড় চাড়ির পানিতে তারা হয়ে ফুটে রয়েছে ছোট ছোট শালুক। পানিতে আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে মাছ।

ছাদের একপাশে ঝুলছে দোলনা
ছবি: কবির হোসেন

ভাবনাটি চমৎকার, মন্তব্য করতেই সাইকা বললেন, ‘মাছ ছেড়ে দিলে পানিতে মশা হয় না। মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। এ জন্যই মূলত মাছ ছেড়েছি।’ সারা ছাদে হাসিমুখে ফুটে রয়েছে দেশি-বিদেশি ফুল। কয়েক পদের জবা, গোলাপ, পাউডার পাফ, লেমোনিয়া, সিলভার কুইন, ফক্সটেইল অর্কিড, বার্ড অব প্যারাডাইস, হ্যালিকোনিয়া, শিউলি, নিশিন্দা, আরও কত কী! খানিক বিরতি দিয়ে দিয়েই অপরাজিতার ঝোপ। এদের মধ্যে একটি সাদাটে ছাইরঙা ছোট ছোট পাতার ঝোপজাতীয় গাছ নজর কাড়ল। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সেটা ছোট আকারের  জলপাইয়ের গাছ (অলিভ ট্রি), সাইপ্রাস থেকে আনা। এরপর দেখা গেল টুকটুকে লাল ফুল। সেটির নাম ‘ফার্স্ট লাভ’। ফুলটা চোখে চিনতাম, কিন্তু নাম যে ফার্স্ট লাভ, কে জানত!

করবী, ক্যাশিয়া, ম্যান্ডারিন, মালবেরি, প্লামবাগো, গ্যালফেমিয়া, রাধাচূড়া, রঙ্গন, কলা, জলপাই, পদ্ম, মন্সটেরা, চায়নিজ মুকুন্দা, ডালিম, সফেদা, ডুমুর, অ্যারোমেটিক জুঁই...কেবল নামগুলো দিয়েই একটা হৃষ্টপুষ্ট ফিচার হয়ে যায়! বুলবুলি পাখিরা খায় মালবেরি। সায়কারা খান পেঁপে, কলা, ডালিম আরও কত কী। কাকেরা টুপ করে এসে শালুক, পদ্মের চাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় মাছ। এখানে-ওখানে মাচার ওপর ছড়িয়ে অলিগলি খোঁজে নীলমণি লতা আর নীল বনলতা।

ছাদবাগানে স্থপতি সাইকা ইকবাল ও তাঁর মেয়ে শ্যামা
ছবি: কবির হোসেন

সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনার এখানে কত পদের গাছ?’ সায়কা বললেন, ‘গুনতে বলবেন না, প্লিজ— এই প্রশ্নের কেবল একটাই উত্তর হয়, “অনেক”।’ ২০১৭ সালের কথা। তখন মাতৃত্বজনিত ছুটি নিয়েছিলেন সায়কা ইকবাল। কাজের মানুষ নাকি কাজ ছাড়া বাঁচে না। তিনি তাই ঘরের বর্ধিত ওই জায়গায় বাগান করা শুরু করলেন। সেটিই এখন বিভিন্ন দেশ, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনা গাছেদের যৌথ সুখী পরিবার। টবগুলোয় নানা সময় আর সংস্কৃতির পেইন্টিং। টবগুলোও রঙিন হয়েছে সায়কার হাতে।

এই অর্কিডজাতীয় পরগাছাগুলো মাটিতে হয় না। তাই নারকেলের খোসায় খরকুটে দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এই গাছ
ছবি: প্রথম আলো

সায়কা ইকবাল বলেন, করোনার বিধিনিষেধে তাঁর সমস্ত একঘেয়েমি, স্থবিরতা আর বিষণ্নতা জমা রেখেছেন এই ছাদের কাছে। এখনো ছাদে বসেই অনলাইনে ক্লাস নেন। শীতে এই ছাদে বসে গানের আড্ডা। যানজটে আটকে থাকা কোটি মানুষের এই শহরে এই ছাদ যেন সবুজ, লাল, নীল, সাদায় ফুটে আছে এক টুকরো প্রশান্তি হয়ে।