ছোট ফ্ল্যাটে বড় জায়গা

বহুকাল ধরেই নিউইয়র্ক, টোকিও, সাংহাই আর হংকংয়ের মতো লোকে লোকারণ্য মেগাসিটিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফ্ল্যাটে কীভাবে জায়গা বাঁচিয়ে একটু আরাম করে থাকা যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। দেদারসে লেখালেখি হচ্ছে জায়গা বাঁচিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটে থাকা মানুষগুলোকে একটুখানি খোলামেলা ভাব আর প্রশস্ততার অনুভব দিতে। আমাদের এই ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা নগরীর বাসিন্দাদের কাছেও কিন্তু এখন বিষয়টি দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ঢাকা শহরের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বাস করছে ছোট ছোট ফ্ল্যাটে
ছবি: হাসান রাজা

এই শহরের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বাস করছে ছোট ছোট ফ্ল্যাটে। ঘিঞ্জি গলিতে সামান্য একচিলতে আকাশ দেখা যায়, এমন ১০০০–১২০০ স্কয়ার ফুটের অ্যাপার্টমেন্টগুলোও ভাড়া হচ্ছে চড়া মূল্যে। আবার করোনার দাপটে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে অনেক পরিবারকে বড় বাসা ছেড়ে ছোট ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠতে হচ্ছে আজকাল। এমন একসময়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের নানা অভিনব কারসাজিতে এই ছোট বাসাগুলোকে যতটা সম্ভব জায়গা বাঁচিয়ে, স্বস্তিকর ও সুন্দরভাবে সাজানো এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সব কারসাজিরই একঝলক এখানে দেখে নেওয়া যাক।

আসবাবে একের ভেতর দুই

সোফা
ছবি: সৌজন্য, হাতিল

আজকের দিনে নাগরিক জীবনে কনভার্টেবল ফার্নিচারের ধারণা সবার মন জয় করে নিয়েছে অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে। একের ভেতর দুই মূলমন্ত্রে তৈরি এই আসবাবগুলো অনায়াসে দু–একটি কবজা খুলে-লাগিয়ে অথবা ঠেলে-ধাক্কা দিয়ে এক রূপ থেকে আরেক রূপে নিয়ে যাওয়া যায়। এ–জাতীয় আসবাবের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে সোফা কাম বেড।

টানলেই হয়ে যাবে বেড
ছবি: সৌজন্য, হাতিল

অতিথির থাকার ব্যবস্থা করতে, এই করোনার সময়ে কারও কোয়ারান্টিনে থাকতে হলে অথবা বাড়িতে এমনিতেই সদস্যসংখ্যা বেশি হলেও সোফা কাম বেড অত্যন্ত কাজের জিনিস হয়ে উঠতে পারে। সহজেই একটু টান দিলে বা ঠেলে নিলেই রূপ পরিবর্তন করা যায় বলে এগুলোতে ঝক্কিও কম খুবই। এ রকম আরও আসবাবের মধ্যে আছে ড্রেসার কাম বুক কেস, যেখানে কাপড় রাখার ড্রয়ারগুলোর ওপরের জায়গাটিতে সংযুক্ত থাকে বইয়ের তাক।

অভিনব সব স্টোরেজের জায়গা

খাট বা সোফার বেইসটিকে বাক্সের মতো ব্যবহার করা যায়
ছবি: সংগৃহীত

আজকাল আলাদা স্টোররুম রাখা ছোট ফ্ল্যাটগুলোতে খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার সংসারে জিনিসপত্রও তো কম থাকে না। তাই সারা বিশ্বেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা বিস্তর মাথা ঘামান ফ্ল্যাটে অভিনব সব স্টোরেজ স্পেস খুঁজে বের করতে। আজকাল বাথরুমের ফলস সিলিংয়ে দরজাসহ গুদামঘর দেখা যায় সব বাসাতেই। একটি ভাঁজ করা মই রাখতে হয় ঘরে তার জন্য, এই যা। এ ছাড়া খাট বা সোফার বেইসটি বাক্সের তরিকায় বানিয়ে তাতে দেরাজ যোগ করলেই কোনো আলাদা জায়গা দখল না করে প্রয়োজনীয় লেপ-কম্বল, কাপড়চোপড়, বইপত্রসহ সবকিছুই রাখা যায় গুছিয়ে। ঠিক একইভাবে, মোড়া, টুল, কফিটেবিল ইত্যাদিও বাক্সের আদলে বানিয়ে অনেক কিছু রাখতে পারা যায়।

দেয়ালের যথাযথ ব্যবহার

রান্নাঘরের দেওয়াল এভাবে ব্যবহার করে রান্নাঘরের জায়গা বাড়ানো যায়
ছবি: মারিয়া ওরলাভা , পেকজেলস ডট কম

দেয়াল জোড়া ঝোলানো শেলফ, বইয়ের তাক, কিচেন বা বাথরুম ক্যাবিনেট—এ সবকিছুই অনেক জায়গা বাঁচিয়ে দেয় ছোট ফ্ল্যাটবাড়িতে। হুকে ঝুলিয়ে ব্যাগ, স্যুটসহ যেকোনো ঢেকে রাখা কাপড়চোপড়, রান্নাঘরের চামচ-হাতা-তৈজসপত্র এসব হাতের কাছে সুন্দরভাবে সাজাতে পারলে খুবই সুবিধাজনকভাবে অনেক জায়গা বাঁচানোর উপায় পাওয়া যায়।

বেডরুম বা লিভিং রুমের দেওয়াল এভাবে ব্যবহার করলে বেশকিছু জায়গা পাওয়া যাবে
ছবি: কটনব্র, পেকজেলস ডট কম

এ ছাড়া টিভি, আয়না, প্রসাধনী রাখার জায়গা ইত্যাদি দেয়ালেই রাখার ব্যবস্থা করা যায় খুব সহজে। হাউস প্ল্যান্ট, টেবিল ল্যাম্প, টেলিফোন থেকে শুরু করে পারলে সবকিছু রাখার জন্য ওয়াল মাউন্টিংয়ের ধারণা এখন খুবই জনপ্রিয়।

ফোল্ডিং বা ভাঁজ করা যায় এমন আসবাব

ফোল্ডিং টেবিল, চেয়ার ছোট ফ্লাটের জায়গা বাঁচিয়ে দেবে
ছবি: সংগৃহীত

হংকং বা সাংহাই শহরে অর্ধেক আসবাবই ভাঁজ করে রাখা যায় প্রায়। ফোল্ডিং টেবিল, চেয়ার আমাদের দেশেও বাসার জায়গা বাঁচাতে খুবই কার্যকর বলে প্রচলিত আছে বহুলভাবে। আজকাল তো ভাঁজ করে ছোট করে রাখা যায়, এমন খাবার টেবিল প্রায়ই ব্যবহার করছি আমরা। এগুলোকে বলা হয় কলাপসিবল টেবিল, যাতে দুজনের বসার ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনে বাড়তি অংশের ভাঁজ খুলে হুক-কবজা লাগিয়ে বড় আকৃতি দেওয়া যায়। এ ছাড়া ভাঁজ করে দেয়ালে আটকে রাখা যায়, এমন পড়ার টেবিল বা ইস্ত্রি করার টেবিলের উল্টো পাশে আয়না লাগানোর বুদ্ধিটাও অসাধারণ।

ঘরের উচ্চতা কাজে লাগানো

ফ্লাটে ফ্লোরের জায়গা বাড়ানো না গেলেও দেওয়ালের জায়গাগুলোকে কাজে লাগানো যায়। ডাবল বাংক বেড
ছবি: কার্টিজ অ্যাডামস, পেকজেলস ডট কম

ফ্ল্যাটবাড়িতে ফ্লোর স্পেস বাড়ানো অসম্ভব। কিন্তু ঘরের উচ্চতা বরাবর উল্লম্ব জায়গাগুলো বুদ্ধি করে ব্যবহার করতে পারলে ছোট ফ্ল্যাটই বড় মনে হবে। দুই সন্তানের শোয়ার ঘরে পাশাপাশি দুটি খাট না দিয়ে দোতলা বাংক বেড ব্যবহার করা যায় অনায়াসেই। আবার উঁচুতে দোতলা খাট রেখে নিচে হতে পারে ডেস্ক বসিয়ে পড়ার ব্যবস্থা। দেয়ালজুড়ে সুউচ্চ আলমারি, ঘরের অব্যবহৃত কোনা বরাবর উঁচু কিন্তু চিকন শেলফ, পড়ার টেবিলের উপরে লম্বাভাবে বসানো বইয়ের তাক, এগুলোই আমূল বদলে দিতে পারে ছোট ফ্ল্যাটের গাদাগাদি ভাব।

প্রস্থে নয়, আসবাবপত্র এখন বাড়া উচিত উচ্চতায়
ছবি: পিক্সাবে, পেকজেলস ডট কম

এই মৌলিক কিছু ধারণার আলোকে নিজেদের ছোট ফ্ল্যাটবাড়িটিতে অবশ্যই খোলামেলা আবহ আনা যায় একটু সৃজনশীল আর বুদ্ধিমান হলেই। আর তার সঙ্গে দেয়ালে আয়নার ব্যবহার, হালকা পেইন্ট লাগানো, হালকা রঙের পর্দা ব্যবহার ইত্যাদি কিছু ব্যাপার খেয়াল রাখলে ছোট ফ্ল্যাটেই বড় জায়গা নিয়ে হাত–পা ছড়িয়ে থাকা সম্ভব পরিবারের সবাই মিলে।