নকশাকারের অন্দরমহল

ছবি: প্রথম আলো

লিপি খন্দকার। নকশাকার ও ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার স্বত্বাধিকারী। ঢাকায় নিজের বাড়ির অন্দর সাজিয়েছেন লোকজ নানা রকম উপাদান দিয়ে। সৃজনশীলতায় ভিন্নমাত্রায় ফুটে উঠেছে লোকজ আবহ।

লিপি খন্দকার
ছবি: প্রথম আলো

‘তখন সবে ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছি। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম, দেখলাম সেখানে কাজে লাগবে না এমন ব্লকগুলো ফেলে দেওয়ার জন্য বস্তায় ভরা হচ্ছে। জানতে পারলাম, মানিকগঞ্জের একটি নদীতে ফেলে দেওয়া হবে এগুলো। অকেজো হলেও ব্লকের ওপরের কারুকাজ ছিল দেখার মতো। কী মনে করে যেন বললাম, এগুলো ফেলে না দিয়ে আমাকে দিয়ে দিতে। তারপর এই ব্লকগুলোই একসময় আসবাব বানানোর কাজে লাগালাম,’ বলছিলেন ডিজাইনার লিপি খন্দকার।
ছবি তুলতে আমরা গিয়েছিলাম ঢাকার নিকেতনে লিপি খন্দকারের বাড়ি। আর তখন বসার ঘরের এই ব্যতিক্রমী নকশার সোফাসেট তৈরির গল্প শোনালেন তিনি।

লিপি খন্দকার, পেশায় পোশাকের ডিজাইনার। তাঁর ঘরে সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। এই বাড়িতে ঘর সাজানোর নানা জিনিসের কোনোটা তাঁর নিজের নকশা করা, আবার কোনোটা কারুশিল্পীর হাতে বানানো। কোনোটা আবার এনেছেন দেশের বাইরে থেকে। লিপি জানালেন, ঘুরতে ভালোবাসেন। যখন যেখানে যান, প্রথমই খুঁজে বের করেন সেখানকার বিশেষ লোকজ পণ্য। ‘আসলে ঘর সাজানোর জন্য লোকজ পণ্য খোঁজাটা আমার একটা শখ।’

লিপি খন্দকার, পেশায় পোশাকের ডিজাইনার। তাঁর ঘরে সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকাটাই স্বাভাবিক
ছবি: প্রথম আলো

ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার স্বত্বাধিকারী লিপি খন্দকারের বাসার প্রবেশপথ দেখলেই বোঝা যায় তা। দামি জিনিসপত্র নয়, বরং সাদামাটা জিনিসও যে রুচিবোধের ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে ওঠে, সেটার উদাহরণ এই বাড়ি।

লিপি খন্দকার, পেশায় পোশাকের ডিজাইনার। তাঁর ঘরে সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। এই বাড়িতে ঘর সাজানোর নানা জিনিসের কোনোটা তাঁর নিজের নকশা করা, আবার কোনোটা কারুশিল্পীর হাতে বানানো। কোনোটা আবার এনেছেন দেশের বাইরে থেকে। লিপি জানালেন, ঘুরতে ভালোবাসেন। যখন যেখানে যান, প্রথমই খুঁজে বের করেন সেখানকার বিশেষ লোকজ পণ্য।
বসার ঘরের আসবাবগুলো একটু সাবেকি আমলের নকশার
ছবি: প্রথম আলো

প্রবেশপথ পেরিয়েই মূল বসার ঘর। এখানে বসার আয়োজনের আসবাবগুলো একটু সাবেকি আমলের নকশার। আসবাবগুলো বেশ নান্দনিক। ব্লকের সোফা তো আছেই, পাশাপাশি আরও কিছু নিচু সোফার আয়োজন। এসব লিপি খন্দকার বানিয়েছেন নিজের নকশায়। সোফার ওপর রাখা ছোট্ট ছোট্ট গদি আর কুশন। পাশবালিশ রাখা আছে আরামের জন্য। আসবাবের সঙ্গে মিল পর্দার নকশায়। কাপড়ের পেলমেটে আসবাবের মোটিফের ব্লক আর পাঁচটি পেয়ারের পর্দাও যেন বহন করছে লোকজ ধারার ঐতিহ্য। অবশ্য এই পর্দার নিচেও আছে আরেক পরতের পর্দা, যাতে বাইরের কড়া আলো সহজেই ঘরে আসতে না পারে।

বসার ঘরের দেয়াল সেজেছে লিপি খন্দকারের সংগৃহীত লোকজ পণ্য দিয়ে। আছে মুখোশ, আয়না, শোপিসসহ আরও কত কী। শুধু দেশ–বিদেশের লোকজ পণ্যই নয়, পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এমন জিনিসের চিহ্নও আছে ঘরে। ‘এই যেমন এখানে যে পানের বাটাগুলো দেখছেন, এর মধ্যে একটা আমার শাশুড়ির নানিশাশুড়ি ব্যবহার করতেন’, জানালেন লিপি।

বসার ঘরের দেয়াল সেজেছে সংগৃহীত লোকজ পণ্য দিয়ে
ছবি: প্রথম আলো

বসার ঘরের পরে খাবার ঘর। নিজের নকশায় সাজিয়েছেন খাবার টেবিল। টেবিলের ওপরটায় শীতলপাটি। সাধারণ খাবার টেবিল এই কারণেই পেয়েছে নান্দনিক রূপ।
মূল বসার ঘর ছাড়াও এই বাসায় আছে ছোট্ট আরেকটি বসার ঘর। যেখানে গল্প, আড্ডায় মেতে ওঠেন সবাই। যদিও পরিসর বেশ ছোট, তবে সাজানোর গুণে তা হয়ে উঠেছে আন্তরিক। ছোট্ট বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা, সাজানো দেয়াল সব গোছানো আর শৈল্পিক।

হাতে আঁকা পটারির ওপর কাঁসার থালা বসিয়ে বানানো টেবিল আলাদা করে চোখে পড়ে
ছবি: প্রথম আলো

ঘরে আরাম–আয়েশের যাতে কোনো ঘাটতি না হয়, সে জন্য শোবার ঘরের সাজ রাখা হয়েছে একেবারেই সাদামাটা। এই ঘরের বিশেষত্ব এক কোণে। যেখানে আছে একটু আয়েশ করে আকাশ দেখার ব্যবস্থা। লিপি খন্দকার বললেন, ‘যখন এই বাসায় আমরা আসি, তখন এই জায়গাটা বেশ প্রিয় হয়ে উঠল। কারণ, এখান থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়। তাই এই আয়োজন।’ ঘরের এই জায়গায় বসার জন্য রাখা হয়েছে নিচু চেয়ার, কুশনে উজ্জ্বল রঙের বাহার। টেবিলের আয়োজনে আছে বেশ বৈচিত্র্য। হাতে আঁকা পটারির ওপর কাঁসার থালা বসিয়ে বানানো টেবিল আলাদা করে চোখে পড়ে। মূল শোবার ঘর থেকে এই জায়গার আয়োজন যে একটু আলাদা, তা বোঝার জন্য ঘরের আর্চে নিজেই করেছেন অঙ্কন চিত্র।

একদিকের দেয়ালজুড়ে রাখা বড় আয়না, কিনেছিলেন কক্সবাজারের বার্মিজ বাজার থেকে। এখানেও রং–তুলির ছোঁয়ায় এনেছেন নিজস্বতা। এসব তো আছেই, সব ছাপিয়ে এই ঘরের কবিতাগুলো ছুঁয়ে যাবে মন। লিপি খন্দকার বলছিলেন, কবিতা ভালোবাসেন তিনি। ইচ্ছা ছিল প্রিয় কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে সাজাবেন ঘর। সেই ভাবনামতো পর্দার ওপর কাঠের পেলমেটে খোদাই করিয়েছেন প্রিয় কবিতার পঙ্ক্তি। দেয়ালজুড়েও লিখতে চেয়েছেন। তবে সময়–সুযোগ পাননি বলে এখনো সেই কল্পনা রূপ নেয়নি বাস্তবে। এই ঘরে আছে নানা আলোর শেডের ব্যবহার। রাতে কবিতার ওপর নানা নকশার আলোর প্রতিফলন ঘরে যোগ করে ভিন্ন ভাষা।

আলোর ব্যবহার এ বাড়ির আরেক বিশেষত্ব
ছবি: প্রথম আলো

আলোর ব্যবহার লিপি খন্দকারের বাড়ির আরেক বিশেষত্ব। বসার ঘর থেকে প্রতিটি ঘরেই দেখা গেল হালকা আলো–আঁধারি। লিপি খন্দকার বলছিলেন, ‘আমার বাসার অন্দরসজ্জার পুরো সৌন্দর্য ধরা দেয় রাতে। কারণ, সাবেকি আমলের নকশার আসবাব, লোকজ এসব পুরোনো নকশার পণ্য আর তার সঙ্গে ল্যাম্প শেডের আলো–আঁধার পুরো ঘরে কেমন জানি একটা মায়াবী আমেজ ছড়িয়ে দেয়।’ আর দিনে? ‘দিনের বেলায় লোকজ নকশার নানা উপকরণ তৈরি করে শৈল্পিক আবহ।’